চট্টগ্রাম

মমতাময়ী মায়ের মনপোড়া অপেক্ষা, আনন্দাশ্রু

জেটিতে জাহাজ ভিড়তেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটছিলেন জোৎস্না বেগম। ছেলের মুখটা একপলক দেখার জন্যে। তখনও জাহাজেই ছিলেন এমভি আবদুল্লাহর নাবিকরা। এরপর জেটিতে পা ফেলতেই উতলা হয়ে উঠলো মায়ের মন। কয়েক মিনিটের অপেক্ষাও যেন দুর্বিষহ লাগছিলো তাঁর কাছে। প্রখর রোদে মাথার ঘাম গাল গড়িয়ে পরে যখন শরীর ভিজছিলো; ঠিক তখনই দেখতে পান ছেলেকে।

দূর থেকে মায়ের ডাক শুনেই ভিড় ঠেলে এক দৌড়ে ছুটে এলেন ছেলে তানভীর আহমেদ। জড়িয়ে ধরলেন একে অপরকে। চোখ বেয়ে ঝড়ছিলো আনন্দধারা। এভাবেই গেল মিনিট কয়েক। এরপর মায়ের দিকে তাকিয়ে তানভীর বললেন, ‘আমি তোমাকে ভীষণ মিস করেছি।’ জবাবে আনন্দাশ্রু নিয়ে বললেন, ‘আজ আমার ঈদ।’

মঙ্গলবার (১৪ মে) বিকেল ৪ টার দিকে চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনালের (এনসিটি) এক নম্বর জেটিতে নাবিকদের বহন করা জাহাজ এমভি জাহান মনি–৩ পৌঁছার পর নাবিকরা নেমে আসা মাত্র তৈরি হয় এমনই আবেগঘন এক পরিবেশের।

এ সময় কথা হয় সোমালিয়ান জলস্যুদের হাত থেকে ছাড়া পাওয়া জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর চতুর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভির আহমেদের মা জোৎস্না বেগমের সাথে। ছেলে ফিরবেন তাই রাতে ঘুমাননি। রাত পোহাতেই ঘুমকাতর চোখে নগরের আগ্রাবাদ এলাকার সিডিএ ১০ নম্বর কলোনির বাসা থেকে ছুটে আসেন এনসিটি এক নম্বর জেটিতে। সাথে ছিলেন তানভীরের স্ত্রী রাহা।

ছেলেকে বুকে জড়িয়েই তিনি সিভয়েস২৪-কে বললেন, ‘আজ রাতে আমার বুকের ধন ছেলেকে নিয়ে একসাথে খাবো। প্রায় ৬ মাস পর আমার ছেলের শরীরের ঘ্রাণ নিলাম। এ আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আমি যেন খুশিতে পাগল হয়ে যাচ্ছি। এখন মনে খুবই শান্তি লাগছে। ছেলের পছন্দের সবকিছু রান্না করেছি।’

পবিত্র রমজান শেষে ঈদুল ফিতরের দিনগুলোতেও বিমর্ষ ছিলেন জোৎস্না বেগম। ছেলে জলদস্যুদের হাতে জিম্মি তাই ঈদও করেননি তিনি। তবে ছেলেকে কাছে পেয়ে হাসির ফোয়ারা তুলে তিনি বললেন, ‘ঈদের সময় মন খুবই খারাপ ছিলো। ছেলে অস্ত্রের মুখে জিম্মি, আমি মা কিভাবে ঈদ করি? আজ আমার ঈদ। আমার বুকের ধন আমার কাছে ফিরে এসেছে।’

মাকে কাছে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন ছেলে তানভীর। চোখে অশ্রু মুখে হাসি নিয়ে বারবার আলিঙ্গন করছিলেন মাকে। সাথে ছিলেন স্ত্রী রাহা। দীর্ঘদিন পর মা এবং স্ত্রীকে কাছে পাবার অনুভূতি জানতে চাইলে তানভীর আহমেদ বলেন, ‘এই খুশি ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। আমি জানতাম আমার মা আমার জন্য পছন্দের খাবার রান্না করেছে। আম্মুর হাতের মাছের তরকারি, শুটকি, গরুর মাংস আর শিমের বিচি—এগুলো আমি খুবই পছন্দ করি। এখন বাসায় যাব, একসাথে পরিবারের সাথে সময় কাটাবো। খুবই এক্সাইটেড আমি। আমাদের চেহারা দেখলেই বুঝা যাবে আমরা কতটা খুশি, যা শব্দে প্রকাশের মতো নয়। আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া আদায় করছি এবং মালিকপক্ষকেও ধন্যবাদ জানাতে চাই।’

জিম্মি থাকাকালীন সেই দুর্বিসহ দিনের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘বেঁচে আসবো কিনা সেটা সন্দেহ ছিলো। পরিবারের সাথে দেখা করবো—এটা যেন স্বপ্ন ছিল আমার জন্য। সময়গুলো খুবই স্লো যাচ্ছিলো আসলে তখন। মনে হচ্ছিলো একেকটা দিন একেকটা বছরের মতো।’

জাহাজে আবার যাবেন কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘জাহাজে চাকরি অবশ্যই করবো। এটা আমাদের রক্তে মিশে আছে। সমুদ্রের পানি যে একবার খেয়েছে সে আবারও যেতে বাধ্য। ইনশাআল্লাহ আমি আবার যাবো।’

মায়ের কোলে ছেলে ফিরেছে সেটাই সবচেয়ে বড় আনন্দের

ছেলে জলদস্যুদের হাতে জিম্মি তাই ঈদ করেনি নাবিক আইনুল হক অভির মা লুৎফে আরা বেগম। তাঁর দিন কেটেছে নানা উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আর শঙ্কায়। ছেলের জাহাজ জিম্মি—এই কথা শুনে অসুস্থও হয়ে পড়েছিলেন। রোজা পালন করেছেন খেয়ে-না খেয়ে। কিন্তু তাঁর ছেলে ফিরেছে তার বুকে। তাই আজই যেন তাঁর ঈদের দিন। ছেলেকে কাছে পেয়ে কেঁদেছেন, কপালে এঁকেছেন আদরের চুমু।

আইনুল হক অভির (৩০) বাড়ি চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলায়। মা এবং ছোট ভাইকে নিয়ে থাকেন নগরীর কাজির দেউড়ির আাশকার দিঘীর শতদল ক্লাব এলাকায় ভাড়া বাসায়। মহামারী করোনার সময় হারিয়েছেন বাবা সুজাউল হককে। ছোট ভাই মাইনুল হক আন্তর্জাতিক ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স শেষ করলেও কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেনি। তাই সংসারের হাল তাঁর ওপরেই।

অভির মা লুৎফে আরা বেগম বলেন, ‘ছেলেকে দেখার পর আর মুখ দিয়ে কথা বের হয়নি। সে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। আমিও তাকে জড়িয়ে ধরেছি। ঈদের আনন্দের মতো আনন্দ লাগছে। বলা যায়, নতুন করে ঈদ ফিরে এসেছে। শুধু আমার ছেলেই নয়, ২৩ ছেলেই স্বদেশে ফিরেছে, তারা তাদের মায়ের কোলে ফিরেছে—এটাই সবচেয়ে আনন্দের।’

‘আমরা তো ছেলের টেনশনে ঈদ পালন করতে পারি নাই। ঈদের সময় আমরা দুশ্চিন্তায় ছিলাম, উৎকণ্ঠায় ছিলাম। আমরা চেয়েছি ঈদের দিনটা আমাদের থেকে তাড়াতাড়ি চলে যাক। কারণ আমার ছেলেরা তখন জিম্মি। এখন মায়ের ছেলে মায়ের বুকে ফিরে এসেছে। এর চেয়ে বড় আনন্দ আর কি আছে, কি হতে পারে।’ যোগ করেন তিনি।

বাড়িতে গিয়ে ছেলেকে নিয়ে কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তাকে বাসায় নিয়ে গিয়ে তার পছন্দের সবকিছু করা হবে। তার বন্ধুরা আসবে। তাদের সবার জন্য খাবার আয়োজন করবো। সব আত্মীয় স্বজন আমাকের কল দিচ্ছে। তারাও অস্থির আমার ছেলেকে দেখার জন্য। ছেলের বিয়ের জন্য মেয়ে দেখা হচ্ছে। সে এখন ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষা দিয়েছে। সামনে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবেই জয়েন করবে।’

আইনুল হকের পছন্দের খাবারের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আইনুল আমার হাতে রান্না করা গরুর মাংস বেশি পছন্দ করে। এছাড়া ডিমের পুডিং এবং ঝাল নাস্তা বেশি পছন্দ করে।’

সেই দুঃসহ স্মৃতি স্মরণ করে বলেন, ‘ঘটনার রাত ২টার দিকে আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। পরে ডাক্তার এসে চেকআপ করে সমস্যা নেই বলে জানান। ডাক্তার জানান, দুশ্চিন্তার কারণে আমি অসুস্থ হয়েছি। পরে পুরো রমজান মাস ঘুমের ওষুধ খেতে বলা হয়।’

পরবর্তী ছেলেকে যেতে দিবেন কিনা— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ঘটে যাওয়া ঘটনাটি একটি দুর্ঘটনা। মালিক পক্ষের আন্তরিকতার কারণে এবং তাদের প্রচেষ্টায় আমাদের ছেলেরা তাড়াতাড়ি মুক্তি পেয়েছে। এখন যাওয়া না যাওয়ার বিষয়টি ছেলে ভালো বলতে পারবে। সেই সিদ্ধান্ত নিতে যাবে কি যাবে না। তবে দুর্ঘটনা সব জায়গায় হতে পারে। শুধু যে জাহাজে হবে তা নয়; সব জায়গায় সব কিছুতে হতে পারে। মানুষ কোনো কাজেই নিরাপদ নয়। সবকিছুর মালিক আল্লাহ। আল্লাহ আমাদের ছেলেকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন।’

এর আগে, এমভি আবদুল্লাহর ২৩ নাবিককে নিয়ে দুপুর ২টার দিকে কুতুবদিয়া উপকূল থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনালের (এনসিটি) এক নম্বর জেটির উদ্দেশ্যে রওনা হয় লাইটারেজ জাহাজ এমভি জাহান মনি-৩। জাহাজ জেটিতে পৌঁছানোর আগেই নাবিকদের বরণ করতে সেখানে জড়ো হন জাহাজের মালিক প্রতিষ্ঠান কবির স্টিল রি-রোলিং মিলস (কেএসআরএম) গ্রুপের এবং চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকর্তারা। এছাড়াও ভার্চুয়ালি সংযুক্ত ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এবং উপস্থিত হন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী।

জাহাজ বন্দরের জেটিতে পৌঁছামাত্র ২৩ নাবিককে ফুল দিয়ে বরণ করে নেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল। এরপর নাবিকরা দেখা করেন তাদের স্বজনদের সাথে এবং যোগ দেন জেটিতে অনুষ্ঠিত একটি সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানে। সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠান শেষে সন্ধ্যা ৬টার দিকে নাবিকেরা কোম্পানির পক্ষ থেকে দেওয়া বাসে করে পরিবারসহ ঘরে ফিরে যান।

উল্লেখ্য, আফ্রিকার মোজাম্বিকের মাপুতো বন্দর থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাত যাওয়ার পথে গত ১২ মার্চ দুপুরে এমভি আবদুল্লাহকে জিম্মি করে সোমালিয়ান জলদস্যুরা। অস্ত্রের মুখে দস্যুরা সেখানে থাকা ২৩ নাবিককে একটি কেবিনে আটকে রাখে। আটকের পর জাহাজটিকে সোমালিয়ার উপকূলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে জিম্মিকালীন সময়ে মালিকপক্ষের তৎপরতায় সমঝোতা হয় জলদস্যুদের সঙ্গে।

১৩ এপ্রিল বাংলাদেশ সময় দিবাগত রাত ৩টা ৮ মিনিটের দিকে এমভি আবদুল্লাহ থেকে দস্যুরা নেমে যায়। এর আগে একই দিন বিকেলে দস্যুরা তাদের দাবি অনুযায়ী মুক্তিপণ বুঝে নেয়। একটি বিশেষ উড়োজাহাজে মুক্তিপণ বাবদ ৩ ব্যাগ ডলার এমভি আবদুল্লাহর পাশে সাগরে ছুড়ে ফেলা হয়। ছোট স্পিড বোট দিয়ে দস্যুরা ব্যাগ ৩টি কুড়িয়ে নেয়। দস্যুমুক্ত হয়ে ১৩ এপ্রিল দিবাগত রাতে সোমালিয়ার উপকূল থেকে আরব আমিরাতের পথে রওনা দেয় এমভি আবদুল্লাহ।

২১ এপ্রিল এমভি আবদুল্লাহ সংযুক্ত আরব আমিরাতের আল হামরিয়াহ পৌঁছে। সেখানে কার্গো খালাস করে জাহাজটি একই দেশের মিনা সাকার থেকে কার্গো লোড করে কুতুবদিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। সোমবার (১৩ মে) সন্ধ্যা ৬টা ৪০ মিনিটের দিকে জাহাজটি ৫৬ হাজার টন চুনাপাথরসহ কুতুবদিয়ায় বঙ্গোপসাগরে নোঙর করে। এর আগেই চট্টগ্রাম থেকে এমভি জাহান মণি-৩ নামে লাইটার জাহাজে করে ২৩ জনের নতুন একটি নাবিকের দল পাঠানো হয় এমভি আবদুল্লাহ জাহাজে। তারা কুতুবদিয়া পৌঁছে আবদুল্লাহর দায়িত্ব বুঝে নিলে পুরোনো ২৩ নাবিক জাহান মনি-৩ জাহাজে করেই রওয়ানা দেয় চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্দেশে।

কবির গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এসআর শিপিংয়ের মালিকানাধীন ‘এমভি আবদুল্লাহ’ আগে ‘গোল্ডেন হক’ নামে পরিচিত ছিল। ২০১৬ সালে তৈরি বাল্ক কেরিয়ারটির দৈর্ঘ্য ১৮৯ দশমিক ৯৩ মিটার এবং প্রস্থ ৩২ দশমিক ২৬ মিটার। গত বছর জাহাজটি এসআর শিপিং কিনে নেয়। বিভিন্ন ধরনের পণ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক রুটে চলাচলকারী এরকম মোট ২৩টি জাহাজ আছে কবির গ্রুপের বহরে।

২০১০ সালের ডিসেম্বরে আরব সাগরে সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল বাংলাদেশি জাহাজ জাহান মণি। ওই সময় জাহাজের ২৫ নাবিক এবং প্রধান প্রকৌশলীর স্ত্রীকে জিম্মি করা হয়। নানাভাবে চেষ্টার পর ১০০ দিনের চেষ্টায় জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্তি পান তারা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d