অন্যান্য

মা এত টাকা কোত্থেকে জোগাড় করবেন, ভেবেই খারাপ লাগত

অঙ্কের ভাষায় বলা যায়, আবদার = অভিমান। অর্থাৎ মায়ের কাছে যতটা থাকে আবদার, ঠিক ততটাই থাকে অভিমান ও অভিযোগ। যদিও মেয়ে হিসেবে অবচেতন মনেই নিজেকে মায়ের অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে হয়। তাই হয়তো কখনো আলাদা করে ধন্যবাদ দেওয়া হয়ে ওঠেনি।

স্কুলে যখন ভর্তি হলাম, মনে হতো আমি বোধ হয় ততটা মেধাবী নই। মনে হওয়ার কারণ হলো, একই পড়া শেষ করতে অন্যদের চেয়ে আমার অনেক বেশি সময় লাগত। এটা নিয়ে প্রায়ই মন খারাপ করে থাকতাম। মাকে কিন্তু আলাদা করে বলতে হয়নি। ঠিকই বুঝতে পেরেছেন। বলেছেন, মেধাবী হওয়ার চেয়ে পরিশ্রমী হওয়া জরুরি। মেধাবীরা ঝরে যেতে পারে, কিন্তু পরিশ্রমীরা ঝরে যায় না। মায়ের উৎসাহেই লেগে রইলাম। না না, একদম প্রথম-দ্বিতীয় হয়ে যাইনি। তবে আমার এই দৃঢ়তা ধীরে ধীরে রোল নম্বর এগিয়ে আনার পাশাপাশি মানুষ হিসেবেও আমাকে সামনে আনতে থাকল।

বয়সের সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্নও বড় হলো। ঠিক করলাম, বুয়েটে পড়ে মাকে গর্বিত করব। কিন্তু প্রচুর পরিশ্রম করেও সুযোগ হলো না। দেশসেরা কোনো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আসনও জয় করতে পারলাম না। প্রচণ্ড ভেঙে পড়লাম। জীবনকে তখন মনে হতো বৃথা। রক্ষাকবচ হয়ে মা-ই আবার হাজির হলো। আবার সেই একই কথা। পরিশ্রম কখনো বৃথা যায় না। এদিকে আমি তো মাকে মুখই দেখাতে পারি না। মা কাছে টেনে আদর করে বললেন, ‘বুয়েট বা সরকারি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেই গর্বিত হব, অন্যথায় হব না, এমন ভাবনা ঠিক নয়। মা, তোমার পরিশ্রম দেখেই আমি খুশি। এত ভেঙে পড়লে চলে না। সামনের দিনে তোমার কাজের ফল দেখার জন্যও আবার উঠে দাঁড়াতে হবে।’

ওই খারাপ সময়েও আদর দিয়ে, মায়া দিয়ে জড়িয়ে রাখার জন্য ধন্যবাদ, মা।

এরপর একরাশ স্বপ্ন নিয়ে মা আমাকে ভর্তি করালেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে। এত টাকা কোত্থেকে জোগাড় করবেন, ভেবেই খারাপ লাগত। মা বোঝালেন, ‘তোমাকে মানুষের মতো মানুষ করার জন্যই তো আমার কষ্ট করা। তুমি শুধু মন দিয়ে পড়ো, ভালো মানুষ হও।’ আমি নতুন উদ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শুরু করলাম। ভালো পড়াশোনা, ভালো ফলাফলের মধ্যে ভয়কে জয় করা শিখে গেলাম। বেশ ভালো ফল নিয়ে স্নাতক শেষ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। সারা জীবনের আরাধ্য ঘটনাটা সেখানেই ঘটল। স্নাতকোত্তরে অর্থনীতি বিভাগে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হলাম। মা বললেন, ‘দেখেছ? পরিশ্রম কিন্তু বৃথা যায় না। শেষ ভালো যার, সব ভালো তার।’

সারাটি জীবন আগলে রেখে পথ দেখানোর জন্য ধন্যবাদ, মা। তুমি আমার শিক্ষক, আমার বন্ধু, আমার দার্শনিক। তুমি আমার পৃথিবী।

লেখক: আফরিন জান্নাত, প্রভাষক, অর্থনীতি বিভাগ, জেডএনআরএফ ইউনিভার্সিটি অব ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সেস, ঢাকা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d