মুজিব থেকে সজীব: মহাকাশে বাংলাদেশ
একটি দেশকে উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে পরিচালিত করার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন ভিশনারি নেতৃত্ব। তাদের ভাবনা ও উদ্যোগের মধ্যে প্রতিফলিত হয় আগামী বিশ, পঁচিশ, পঞ্চাশ ও একশ বছরে দেশকে উন্নয়নের কোনো স্তরে নিতে হবে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৩ বছরের রাষ্ট্র পরিচালনার ইতিহাসের পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধুকন্যা—এই পরম্পরা নেতৃত্ব ভিশনারি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রাষ্ট্র পরিচালনার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের এসব উদ্যোগের মূলে ছিল তার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলা এবং বাংলাদেশকে বিশ্বে একটি মর্যাদাশীল রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সব উদ্যোগের মূলে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করা এবং ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত-সমৃদ্ধ স্মার্ট সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করা।
এ নিবন্ধে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধুকন্যার দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার বিশাল কর্মযজ্ঞ নিয়ে আলোচনা মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। ১২ মে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ দিবস এবং আগামী ১৪ জুন বেতবুনিয়া উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্র উদ্বোধনের ৪৯ বছর পূর্ণ হবে। এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ ও স্মরণীয় ঘটনাকে সামনে রেখে স্যাটেলাইট যুগে প্রবেশ আমাদের জন্য কতটা প্রয়োজন ছিল, তা নিয়ে একটি নিবন্ধ রচনার তাগিদ অনুভব করছি। ফলে নিবন্ধের আলোচনায় গুরুত্ব পেয়েছে বাংলাদেশের স্যাটেলাইট যুগে প্রবেশের ভিত কবে রচিত হয়েছিল এবং সেই ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী এবং তাঁরই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের সাহসী, সৎ ও মেধাবী নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের প্রাসঙ্গিক বিষয়।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি ক্ষমতায় আসীন হয়ে মাত্র সাড়ে তিন বছর রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। কিন্তু এই স্বল্প সময়ে আমরা যদি শুধু তার স্যাটেলাইট যুগে প্রবেশে কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়নের উদ্যোগগুলোর দিকে তাকাই তাহলে দেখা যাবে তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণে কতটা বিচক্ষণ ছিলেন। আর কতটা ভিশনারি ছিলেন তাঁর সব উদ্যোগ। এই দেশকে নিয়ে তাঁর ভাবনা কতটা উচ্চ ছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। দেশ পুনর্গঠন এবং মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের মতো মৌলিক চাহিদা পূরণ করাই জাতির সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেয়। তা সত্ত্বেও তিনি এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার পাশাপাশি স্যাটেলাইট যুগে প্রবেশের ভিত রচনায় নানা উদ্যোগ গ্রহণ ও তাঁর বাস্তবায়ন করেন।
জাতিসংঘের ১৫টি সংস্থার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন (আইটিইউ)। এ সংস্থাটি স্যাটেলাইটের অরবিট/ফ্রিকোয়েন্সি বরাদ্দসহ বিশ্বব্যাপী তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সম্প্রসারণের সমন্বয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। বঙ্গবন্ধু সরকারের কূটনৈতিক উদ্যোগে বাংলাদেশ ১৯৭৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর আইটিউইর সদস্যপদ লাভ করে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দেশে আর্থ-রিসোর্স টেকনোলজি স্যাটেলাইট (ইআরটিএস) প্রোগ্রামের বাস্তবায়ন করা হয়। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে সাফল্যের পথ বেয়ে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বাংলাদেশ ল্যান্ডস্যাট প্রোগ্রাম (বিএলপি) অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বিএলপি-ই কিন্তু দেশে জাতীয় মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠান (SPARSO) গঠনের পথ সুপ্রশস্ত করে।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বঙ্গবন্ধু বেতবুনিয়া উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্রের উদ্বোধন করেন। বিস্মিত হতে হয় এই ভেবে যে, বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশের স্যালোইট যুগে প্রবেশ নয়, মহাকাশ গবেষণার পথও সুগম করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দীর্ঘ ২১ বছর স্যাটেলাইটের এলিট ক্লাবের সদস্য হওয়া ও মহাকাশ গবেষণার পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য গৃহীত উদ্যোগুলো থেমে যায়।
দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পথ ধরে ১৯৯৬ সালে দেশের জনগণ আরেক ভিশনারি নেতা বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার ওপর জনগণ আস্থা রাখে। তিনি ১৯৯৬-২০০১ এবং ২০০৯ সাল টানা চার বার রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন। তিনিই রূপকল্প ২০২১ ঘোষণা করেন, যার মূল উপজীব্য ডিজিটাল বাংলাদেশ। নির্ধারিত সময়ে তাঁর বাস্তবায়নও করেন। লক্ষণীয়, ডিজিটাল বাস্তবায়নের সময়কালে বাংলাদেশের মহাকাশ জয়ের ইতিহাস সৃষ্টিকারী ঘটনাটি ঘটে। ২০১৮ সালের ১২ মে বাংলাদেশ সময় রাত ২টা ১৫ মিনিটে। মহাকাশ বিজয়ের এই মাহেন্দ্র ক্ষণের সাক্ষী ছিলাম আমি নিজেও। উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় ভাইয়ের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টারের লঞ্চ প্যাডে উপস্থিত থেকে সেদিন মার্কিন বেসরকারি মহাকাশ গবেষণা সংস্থা স্পেসএক্সের ‘ফ্যালকন-৯’ রকেটে উৎক্ষেপণের এই মহালগ্নের সাক্ষী হতে পেরে আমি নিজেকে খুবই ভাগ্যবান মনে করছি। আমরা মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট- ১ উৎক্ষেপণ করেছি। বিশ্বে স্পেস সোসাইটিতে ৫৭তম স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণকারী দেশ বাংলাদেশ মহাকাশ জয় আমাদের অহংকার। মহাকাশে বাংলাদেশের এই অস্তিত্ব জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় চলমান স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের সংগ্রাম এগিয়ে নেওয়ার এক উজ্জ্বল সোপান।
স্যাটেলাইট একটি দেশের উন্নয়নের জন্য কতটা প্রয়োজন, সে বিষয়ে সংক্ষেপে আলোকপাত করছি। একথা অনস্বীকার্য, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিচক্ষণতা ও দক্ষতা এবং খ্যাতিমান তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সজীব ওয়াজেদ জয়ের পরামর্শ, দিকনির্দেশনা ও তদারকিতে আমরা সাফল্যের সাথে ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করেছি। আর এই ডিজিটাল বাংলাদেশেরই একটি মাইলফলক অর্জন বঙ্গবন্ধু স্যাটলোইট-১। স্যাটেলাইটের ক্যাটাগরি নির্ধারণ, নির্ধারিত সময়ে ও সাশ্রয়ী মূল্যে বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন সজীব ওয়াজেদ জয়। তারই নিরলস প্রচেষ্টায় বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের নির্মাণ কাজ নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ হয়। স্যাটেলাইটের নানা ক্যাটাগরি রয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ একটি ভূ-স্থির যোগাযোগ স্যাটেলাইট (Geostationary Communication Satellite)। এটি শুধু নিরবচ্ছিন্ন কানেক্টিভিটি নিশ্চিত করছে না, দেশে মহাকাশ গবেষণা, মহাকাশ (স্পেস) অর্থনীতি ও ডিজিটাল অর্থনীতি গড়ে তোলার কার্যক্রম আরও জোরালো করছে।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ নিরবচ্ছিন্নভাবে ১৫ বছরের অধিক সময় মহাশূন্যে থেকে সেবা দিয়ে যাবে। এ স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া যাচ্ছে উচ্চগতির ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ। স্যাটেলাইটটিতে ৪০টি ট্রান্সপন্ডার আছে, যা থেকে ১৬০০ মেগাহার্টজ ফ্রিকোয়েন্সি পাওয়া যাবে এবং এর অর্ধেক অর্থাৎ ২০টি ট্রান্সপন্ডারের ৮০০ মেগাহার্টজ নিজেদের ব্যবহারের জন্য রেখে বাকিটা বিদেশি চ্যানেলগুলোর সেবা প্রদানের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করার জন্য বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আলোচনা চলছে। দেশের প্রায় ৩০টি টিভি চ্যানেল বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট ব্যবহার করছে। এ থেকে সরকারের আয় প্রায় ১২০ কোটি টাকা। এর আগে এসব চ্যানেলগুলো সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশের মালিকানাধীন স্যাটেলাইটের ওপর নির্ভরশীল ছিল। এসব চ্যানেলগুলো বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ ব্যবহার করায় বিদেশ নির্ভরতা কমেছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হচ্ছে। চালুর পর থেকে তিন বছরে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ থেকে বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট লিমিটেড (বিএসসিএল) ৩০০ কোটি টাকার বেশি আয় করে। কোম্পানির মাসিক আয় প্রায় ১০ কোটি টাকা, যার প্রায় পুরোটাই দেশীয় বাজার থেকে অর্জিত হচ্ছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রধানমন্ত্রী অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নকে প্রাধান্য দেন। সব অঞ্চল ও সব মানুষের কাছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সুবিধা পৌঁছে দিয়ে তাদের জীবন ও জীবিকার উন্নয়ন নিশ্চিত করতে চান। কিন্তু অপটিক্যাল ক্যাবল লাইনের দ্বারা দুর্গম এলাকা বিশেষ করে দ্বীপ এবং পার্বত্য অঞ্চলে অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবল লাইন পৌঁছানো দুরূহ ও ব্যয়বহুল। সেখানে ইন্টারনেট লিঙ্কড যোগাযোগ ও ডেটা সার্ভিসের বিকল্প উপায় হতে পারে স্যাটেলাইট। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর সেবার আওতায় দেশের ৩১টি দুর্গম ও প্রত্যন্ত দ্বীপাঞ্চলের ১১২টি স্থানে টেলিযোগাযোগ সেবা দেওয়া হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে আরও বেশি দুর্গম ও প্রত্যন্ত এলাকার সুবিধাবঞ্চিত জনগণকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর সেবার আওতায় আনা হচ্ছে।
এ কথা আজ সর্বজনবিদিত, দেশ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু, উন্নয়ন দিয়েছেন শেখ হাসিনা এবং সমৃদ্ধ আগামীর প্রতিচ্ছবি সজীব ওয়াজেদ জয়। আজ বাংলাদেশে স্যাটেলাইট কমিউনিকেশনসহ তথ্যপ্রযুক্তিতে যে অগ্রগতি সাধিত হয়েছে তাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ও আর্কিটেক্ট অব ডিজিটাল বাংলাদেশ সজীব ওয়াজেদ জয়—এই ত্রয়ী নেতৃত্বের অবদান চির অম্লান হয়ে থাকবে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও মানুষের স্বাচ্ছন্দ্যের বিষয়টি সামনে রেখে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের অগ্রযাত্রাকে মসৃণ করায় ২০২৫ সালের মধ্যে দ্বিতীয় স্যাটেলাইট ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২’ উৎক্ষেপণের লক্ষ্য নির্ধারণ করে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। স্মার্ট বাংলাদেশের সফল বাস্তবায়নের পথ বেয়ে গড়ে উঠবে বঙ্গবন্ধুর সুখী সমৃদ্ধ সোনার বাংলা।
ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নের ফলে উন্নয়নের প্রতিটি সূচকে বাংলাদেশের অভাবনীয় সফলতায় বিশ্বে আজ বাংলাদেশ অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। স্মার্ট বাংলাদেশের সফল বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় ২০৪১ সালের বাংলাদেশ হবে বুদ্ধিদীপ্ত, উদ্ভাবনী, জ্ঞাননির্ভর উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। আমি দৃঢ়ভাবে আশাবাদী অগ্রগতির বর্তমান এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৪১ সালে অনেক আগেই বাংলাদেশ তার অভিষ্ট লক্ষ্যের ঠিকানায় পৌঁছুবেই ইনশাল্লাহ।
লেখক: জুনাইদ আহমেদ পলক, প্রতিমন্ত্রী, ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়