যে কারণে কোরআনের ওপর ঈমান রাখা জরুরি
পবিত্র কোরআন সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানি গ্রন্থ। মহান আল্লাহ তা শেষনবী মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর মানবজাতির ইহকাল ও পরকালের সার্বিক নির্দেশনা দিতে অবতীর্ণ করেছেন। কোরআনের সংজ্ঞায় বিশেষজ্ঞ আলেমরা বলেছেন, ‘এটি মহান আল্লাহর কথা যা মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর ধারাবাহিকভাবে অবতীর্ণ হয়েছে। যা তিলাওয়াত করা ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত।
অতীতের সব আসমানি কিতাব বিশ্বাস করাকে মুমিনদের বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘মহান রবের পক্ষ থেকে যা অবতীর্ণ হয়েছে রাসুল তার ওপর ঈমান এনেছেন এবং মুমিনরাও, সবাই আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতা, কিতাব ও রাসুলদের ওপর ঈমান এনেছেন। ’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৮৫)
পবিত্র কোরআন একসঙ্গে অবতীর্ণ হয়নি। বরং তা দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে বিভিন্ন অবস্থা ও ঘটনার প্রেক্ষিতে অবতীর্ণ হয়েছে। সাধারণত সাহাবিরা কোরআনের আয়াত মুখস্ত করতেন। পাশাপাশি রাসুল (সা.)-এর তত্ত্বাবধানে ওহি লেখকরা পাথর, চামড়া, খেজুরের ডাল, বাঁশের টুকরোসহ বিভিন্ন স্থানে আয়াত লিখে বিক্ষিপ্তিভাবে সংরক্ষণ করা হয়। রাসুল (সা.)-এর মৃত্যুর পর হাফেজদের স্মৃতিতে ও বিভিন্ন স্থানে কোরআন সংরক্ষিত ছিল।
এরপর আবু বকর (রা.)-এর যুগে ওহি লেখক জায়েদ বিস সাবিত (রা.)-এর নেতৃত্বে সুরার ধারাক্রম অনুসারে পুরো কোরআন সংকলিত হয়। হাফসা (রা.)-এর কাছে থাকা সেই কপির অনুসরণ করে পরবর্তীতে উসমান (রা.)-এর সংকলিত কোরআনের কপি পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয় এবং বর্তমানে সেটাই তিলাওয়াত করা হয়। (আল-ইতকান, পৃষ্ঠা : ৬০/১)
রাসুল (সা.)-এর যুগ থেকে পবিত্র কোরআন সুরক্ষার ধারাক্রম নিয়ে আলেমদের মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই। এই কারণে তা ইসলামী শরিয়তের অকাট্য দলিল হিসেবে স্বীকৃত, অর্থাৎ কোরআনের প্রতিটি শব্দ, বাক্য, আয়াত, সুরা অকাট্যভাবে প্রমাণিত। ইমাম আল-আমাদি (রহ.) বলেন, আলেমরা এ বিষয়ে একমত, আমাদের পর্যন্ত কোরআন যেভাবে ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত হয়েছে এবং আমরা যেভাবে কোরআন শিখেছি তাই শরিয়তের অকাট্য দলিল হিসেবে গণ্য হবে। (আল-ইহকাম, পৃষ্ঠা : ১৩৮/১)
তাই কোরআনকে সত্য বলে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করা, এর আদেশ-নিষেধ অনুসরণ করা সব মুমিনের কর্তব্য। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে ঈমানদাররা, তোমরা ঈমান আনো আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের ওপর, ওই কিতাবের ওপর যা তিনি তাঁর ওপর অবতীর্ণ করেছেন এবং ওই কিতাবের ওপর যা তিনি অতীতে অবতীর্ণ করেছেন। যে আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতা, কিতাব, রাসুল ও আখিরাত প্রত্যাখ্যান করল সে মারাত্মকভাবে পথভ্রষ্ট হলো। ’ (সুরা: নিসা, আয়াত : ১৩৬)
কোরআনের কোনো অক্ষর, আয়াত বা অংশ অস্বীকার করা কুফরি। এ বিষয়ে উম্মাহর উলামাদের মধ্যে ঐক্য আছে। নিম্নে তা উল্লেখ করা হলো-
ক. আবু উসমান আল-হাদ্দাস (রহ.) বলেন, আলেমরা এ বিষয়ে একমত যে বিশ্বের নানা প্রান্তে প্রচলিত উসমান বিন আফফান (রা.)-এর সংকলিত মাসহাফ পবিত্র কোরআন হিসেবে স্বীকৃত। এর কোনো অংশের ব্যাপারে সংশয় রাখা যাবে না। এর ভেতর যা আছে তা ছাড়া নামাজ শুদ্ধ হবে না। মূলত সব সাহাবি ও মুসলিম উম্মাহর ঐকমত্যের ভিত্তিতে মাসহাফে উসমানির বিশেষ এ অবস্থান তৈরি হয়েছে। তাই এ কথা বলা যায় যে মাসহাফে উসমানির কোনো অংশের বিরুদ্ধাচরণ করল সে কুফরি করল। (আত-তামহিদ, পৃষ্ঠা : ২৭৮/৪)
খ. ইবনে কুদামাহ আল-মাকদিসি (রহ.) বলেন, মুসলিমদের মধ্যে এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই যে কেউ একটি আয়াত বা সর্বসম্মত কোনো বাক্য বা অক্ষরের বিরুদ্ধাচরণ করলে সে কাফির বলে গণ্য হবে। (আল-মুনাজারাতু ফিল কোরআন, পৃষ্ঠা : ৩৩)
গ. ইমাম নববী (রহ.) বলেন, পবিত্র কোরআন দ্বিধাহীনভাবে সম্মান করা ও এর সুরক্ষার ব্যাপারে সবার সচেষ্ট হওয়া ওয়াজিব।
উম্মাহর মধ্যে এ বিষয়ে ঐকমত্য রয়েছে যে কেউ কোরআনের সর্বসম্মত কোনো অক্ষর অস্বীকার করলে বা কোনো অক্ষর বৃদ্ধি করলে, যা আগে কেউ পড়েনি অথচ সে এ বিষয়ে অবগত তাহলে সে কাফির। (আল-মাজমুউ, পৃষ্ঠা : ১৯২/৩)
ঘ. আল্লাম কাজি ইয়াজ (রহ.) বলেন, কেউ কোরআন বা এর কোনো অক্ষর অস্বীকার করলে তার কুফরির ব্যাপারে মুসলিমদের মধ্যে ঐক্য রয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘কেউ কোরআন বা মাসহাফ বা এর সামান্য অংশ নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বা গালমন্দ করে বা এর কোনো অক্ষরের বিরোধিতা করে বা এমন কিছু মিথ্যারোপ করে যে ব্যাপারে সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে কিংবা এমন কিছু সাব্যস্ত করে, যার নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। অথচ সে এ বিষয়ে অবগত, তাহলে সে মুসলিম ঐকমত্যের ভিত্তিতে কাফির বলে গণ্য হবে। (আল-শিফা, পৃষ্ঠা : ১১০৫)
ঙ. ইবনে তাইমিয়াহ (রহ.) বলেছেন, কেউ যদি মনে করে কোরআনের কিছু অংশ অপূর্ণ রয়েছে বা এতে বৃদ্ধি করা হয়েছে বা এর কিছু আয়াত গোপন রয়েছে অথবা মনে করে যে তার কাছে এমন ব্যাখ্যা আছে, যার কারণে আমলের প্রয়োজন হবে না, তাহলে নিঃসন্দেহে সে কুফরিতে রয়েছে। (আস-সারিম আল-মাসলুল, পৃষ্ঠা : ১২১/৩)
মহান আল্লাহ আমাদের যথাযর্থভাবে কোরআন অনুসরণের তাওফিক দিন। আমিন।