যে কারণে মানুষ সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ
মানুষ আল্লাহর সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। অন্যান্য সৃষ্টির পরিচয় আর মানুষের পরিচয় এক নয়। আল্লাহতায়ালা মানুষকে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বা সৃষ্টির সেরা করে সৃষ্টি করেছেন। বিশ্ব চরাচরে সৃষ্টিকুলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সম্মান ও মর্যাদাবান হচ্ছে মানুষ।
মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্যকে দুইভাগে ভাগ করা যায়। এক. মানবজাতির কল্যাণ সাধন করা, তাদের সৎকাজের আদেশ দেওয়া এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখা। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি। মানবজাতির কল্যাণ সাধন করার জন্য তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা মানুষকে সৎকাজের আদেশ দেবে এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখবে। আর আল্লাহকে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করবে।’ (সুরা আলে ইমরান ১১০) দুই. মানবজাতি আল্লাহর ইবাদত করবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি মানুষ ও জিন জাতিকে সৃষ্টি করেছি একমাত্র আমার ইবাদত করার জন্য।’ (সুরা জারিয়াত ৫৬)
এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো। এক. সৎকাজ করা এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত থাকা যেমন প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য, তেমনি অপরকে সৎকাজের জন্য আদেশ দেওয়া এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখাও পবিত্র দায়িত্ব। যেসব গুণ ও বৈশিষ্ট্য ইসলামকে দিয়েছে অনন্যতা, সেগুলোর অন্যতম হলো সৎকাজের আদেশ দান এবং অসৎ কাজ থেকে বাধা প্রদান। অতএব মানুষকে সৎকাজের আদেশ দেওয়া এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখা মুমিন বান্দার কর্তব্য।
দুই. পৃথিবীতে মানুষের মূল দায়িত্ব হলো আল্লাহর ইবাদত করা। ‘ইবাদত’ আরবি শব্দ। এর অর্থ আনুগত্য করা, দাসত্ব করা। আল্লাহর দাসত্ব ও আনুগত্যই হলো ইবাদত। ইসলামি পরিভাষায় আল্লাহ ও তার রাসুলের নির্দেশিত পথ ও মতে জীবন পরিচালিত করাকে ইবাদত বলে। আল্লাহ মানুষ ও জিন জাতিকে তার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। ইবাদতের মূল উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন।
আল্লাহতায়ালা আমাদের তার ইবাদত ও আনুগত্যের প্রতি বারবার নির্দেশ দিয়েছেন। যেন আমরা প্রতিদান লাভ করতে পারি এবং তার আজাব থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারি। মুসলিম মানেই আল্লাহর ইবাদত, আনুগত্য এবং বিশুদ্ধ নিয়ত লালনের প্রতি আদিষ্ট। এমনকি সাধারণ বৈধ কাজগুলোতেও একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের নিয়ত করাই কাম্য। তবেই সহজে আল্লাহর ভালোবাসা ও নৈকট্য হাসিল হবে। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘(হে নবী) আপনি বলুন, আমার নামাজ, আমার ইবাদত, আমার জীবন এবং আমার মরণ বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহর জন্যই।’ (সুরা আনআম ১৬২)
মানুষের পরিচয় হলো, মানুষ আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি। আল্লাহর প্রতিনিধির জন্য পৃথিবীর সবকিছু সৃষ্টি করা হয়েছে। আর মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য। এ প্রসঙ্গে হাদিসে কুদসিতে এসেছে, ‘হে আদম সন্তান! আমি তোমাকে কেবলমাত্র আমার নিজের জন্য সৃষ্টি করেছি, আর অন্য সবকিছুকে সৃষ্টি করেছি তোমার জন্য। তোমার ওপর আমার যে অধিকার আছে, তা তুমি যেন কখনো ভুলে না যাও। যেসব জিনিস আমি তোমার জন্য সৃষ্টি করেছি তাতে যেন কখনো এতটা মনোযোগী হয়ে না যাও, যাতে তোমাকে যার জন্য সৃষ্টি করেছি, তার কথা ভুলে যাবে। হে মানুষ! আমি তোমাকে আমার নিজের জন্য সৃষ্টি করেছি। এটাকে তুমি খেলা মনে করো না। আমি তোমার রিজিক এবং প্রয়োজনীয় জিনিস পরিবেশনের দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। অতএব তুমি হতাশাগ্রস্ত হবে না। হে মানুষ! তুমি আমাকে পেতে চাইবে, তুমি আমাকে পাবে, যদি তুমি আমাকে পেয়ে যাও তবে তো সব কিছু পেয়ে গেলে। কিছুরই অভাব থাকবে না। কিন্তু তুমি যদি আমাকে হারিয়ে ফেলো, তাহলে তুমি হলে সর্বহারা। আমি যেন হই তোমার কাছে সর্বাধিক প্রিয়।’
আল্লাহতায়ালা আমাদের ওপর বিভিন্ন ইবাদত ফরজ করেছেন। যেমন নামাজ, রোজা, জাকাত ও হজ। এছাড়াও ইবাদতের মধ্যে আরও রয়েছে আল্লাহর জিকির করা, দোয়া করা, তাসবিহ-তাহলিল পাঠ করা, কোরআন তেলাওয়াত, বাবা-মায়ের সেবা, আত্মীয়তা রক্ষা, দান-সদকা করা, রোগীর সেবা করা, হালাল উপার্জন ইত্যাদি।
আল্লাহতায়ালা আমাদের ওপর যেসব ইবাদত ফরজ করেছেন এবং যেসব হারাম বস্তু থেকে বেঁচে থাকতে নিষেধ করেছেন, তা আমাদের ওপর আল্লাহর হকসমূহের কতিপয় হক। কেননা বান্দার ওপর আল্লাহর হক হলো, তাকে সর্বদা স্মরণ করা, ভুলে না যাওয়া, তার আনুগত্য করা, অবাধ্য না হওয়া, তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা, অকৃতজ্ঞ না হওয়া। সন্তান, পরিবার, ধন-সম্পদ ও নিজের জীবন অপেক্ষা তাকে বেশি ভালোবাসা এবং সবকিছুর ওপর তার ভালোবাসাকে প্রাধান্য দেওয়া। আর বান্দা তার কাছে পরিপূর্ণরূপে বিনয়ী ও অবনত হবে এবং তার হেদায়েত পেয়ে সর্বাধিক খুশি হবে। সুতরাং আল্লাহ তায়ালাই সত্তাগতভাবে সব ইবাদতের হকদার।
একজন মুসলিমের সারাটা জীবনই ইবাদত। আল্লাহতায়ালা ইবাদতের সময়সীমাও ঘোষণা করেছেন। কখনো এর থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার সুযোগ নেই। বরং দুনিয়ায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে পরকালের সূচনার সময়টুকু পর্যন্ত ইবাদতের চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। এটাই ইবাদতের শেষ সময়। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আর আপনার পালনকর্তার ইবাদত করুন, যে পর্যন্ত আপনার কাছে সুনিশ্চিত ক্ষণ (মৃত্যু) না আসে।’ (সুরা হিজর ৯৯)
কাজেই যতদিন সূর্য উদিত হবে, নতুন দিনের সূচনা হবে, ততদিন আল্লাহর ইবাদতের কথা ভুলা যাবে না, বরং বারবার স্মরণ করতে হবে। মহান আল্লাহ আমাদের সেই তাওফিক দান করুন।