রাঙ্গুনিয়ায় জুট মিলে বেতন বৈষম্যের অভিযোগ
রাঙ্গুনিয়া (চট্টগ্রাম) : চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় অবস্থিত ‘কেএফডি জুট মিল’ ভাড়াভিত্তিক ইজারা দেওয়া হয়েছে ইউনিটেক্স জুট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডকে। বর্তমানে এই জুট মিলের বিরুদ্ধে উঠেছে বেতন বৈষম্য, স্বজনপ্রীতিসহ নানান অভিযোগ।
মিলের ফোরাত ইউনিটে কাজ করা রাঙ্গুনিয়ার বাসিন্দা একজন নারী শ্রমিক একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘মিলে কাজ করা অন্যান্য জেলার লোকদের বেতন বাড়ানো হয়, কিন্তু স্থানীয় শ্রমিকদের বেতন বাড়ানো হয় না।’
তিনি বলেন, ‘মিল চালু হওয়ার পর থেকেই আমি এখানে কাজ করছি, প্রতিদিন বেতন পাই ২৮০ টাকা। আমার মতো একই কাজ করে এরকম অনেকের বেতন আমার চেয়েও বেশি। এর কারণ আমি স্থানীয় আর ওনারা উত্তরবঙ্গের। যেখানে ৮ ঘন্টা কাজ করে আমাদের পারিশ্রমিক ২৮০ টাকা, সেখানে তারাও ৮ ঘন্টা কাজ করে বেতন পায় ৩০০ থেকে ৩২০ টাকা।’
একই ইউনিটের আরেক স্থানীয় নারী শ্রমিক জানান, তার বেতন আগে ২৬০ টাকা ছিল এখন ১০ টাকা বাড়িয়ে ২৭০ টাকা করা হয়েছে। তবে একই কাজ করে এরকম অন্যান্য জেলার শ্রমিকদের বেতন বেশি দেওয়া হয়। আর এ বিষয়টি তাদের কাছ থেকে গোপন রাখা হয়। এডমিন ম্যানেজার আসলাম হোসেনের স্বজনপ্রীতির কারণে উত্তরবঙ্গের শ্রমিকরা বেতন বেশি পান বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
একই ইউনিটের একজন পুরুষ শ্রমিক বলেন, ‘আমি ৪-৫ মাস আগে মিলে যোগদান করি। আমার বেতন ৩০০ টাকা। তবে তা দিয়ে পোষায় না। আর সবসময় একটা সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। সেটি হলো ঠিকঠাক মতো নাস্তাও করার সুযোগ দেয় না কর্তৃপক্ষ। একটু দেরি হলেই বেতন কেটে নেয়।’
জানা যায়, কর্ণফুলী জুট মিল, ফোরাত কার্পেট কারখানাসহ তিনটি কারখানা নিয়ে থাকা কেএফডি জুট মিল ২০ বছরের জন্য ইজারা দেওয়া হয়েছে বেসরকারি ইউনিটেক্স গ্রুপকে। কারখানার নতুন নামকরণ করা হয়েছে ‘ইউনিটেক্স জুট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’। গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি ইউনিটেক্সকে কারখানাটি হস্তান্তর করা হয়। সংস্কার শেষে ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে উৎপাদনে যায় প্রতিষ্ঠানটি।
বর্তমানে ৪৭ একর আয়তনের এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছে ৭ শতাধিক শ্রমিক। যেখানে দুটি শিফটে দৈনিক ২০ টনেরও বেশি জুট থেকে সুতা উৎপাদিত হয়। যা চীন, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, তুর্কি, ভিয়েতনামসহ বিশ্বের ১২টি দেশে রপ্তানি করে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে কার্পেট, জুট ব্যাগসহ আরও বিভিন্ন উপকরণ উৎপাদনের প্রক্রিয়া চালাচ্ছে বেসরকারি এই শিল্প প্রতিষ্ঠানটি।
এদিকে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে জুট মিলের এডমিন ম্যানেজার আসলাম হোসেন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘কোম্পানি যোগ্যতা এবং পদবি অনুযায়ী বেতন ধরে। কারও যোগ্যতা বেশি হলে আমি অন্তত আরও ৫ টাকা বাড়িয়ে দেই।’
তিনি বলেন, ‘এখানে কিছু শ্রমিক আছে যারা সবসময় কাজের পরিবেশ নষ্ট করে। পুরাতন যে মিলগুলো যেভাবে বন্ধ হয়েছে, ঐ ধরনের একটি অস্থিরতা তৈরি করার চেষ্টা করছে। তারা সবসময় ফাঁকিবাজি করে চলে। আর এদিকে যেহেতু আমাদের কোম্পানি একটি টাইম এটেন্ডেন্স ডিভাইস সেট করেছে, সেহেতু ঢুকা কিংবা বের হওয়ার সময় সেটা ফেস ডিটেক্ট করে, তাই বেতন কাটার বিষয়ে আমার হাত নেই।’
স্থানীয়দের তুলনায় অন্যান্য জেলার শ্রমিকদের সুযোগ সুবিধা বেশি দেওয়া হয়, এ অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা। বর্তমানে ৭০ ভাগ লোক স্থানীয়, রাঙ্গুনিয়ার লোক।
মিলটির ডিরেক্টর রায়হান আহমেদ একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘মিলে সমস্যা ছিল। আগে উত্তরবঙ্গ থেকে যে লোকগুলো আসতো তারা ওখানে থাকতো ওরাই মারামারিসহ বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি করতো। আমি আসার পর ঐ লোকগুলোকে সরিয়ে ফেলেছি। এখন তো মিলে কোনো অভিযোগ নেই। তবুও অভিযোগের বিষয়গুলো খতিয়ে দেখব।’
তিনি বলেন, ‘আমার তো এখন সব রাঙ্গুনিয়ার লোক। কেউ কি বলতে পারবে এখন কেউ কাউকে গালি দিয়ে কথা বলে?কেউ বলতে পারবে, কেউ কাউকে তুই করে কথা বলে?’
বেতন কাটার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটা তো নিয়ম। যদি কেউ এক ঘন্টা পরে কাজে আসে বা এক ঘন্টা আগে কাজ থেকে চলে যায় সে ক্ষেত্রে বেতন তো কাটা যাবে। কারণ সেখানে মেশিন লাগানো আছে। তাই অটোমেটিক কাটা যাবে।’বেতন বৈষম্যের বিষয়ে বলেন, ‘এটা সঠিক। কারণ দক্ষ লোক আর নতুন শ্রমিকের বেতনে ব্যবধান থাকবেই। চাকরিতে যোগ দেওয়া মাত্র বেতন বাড়ানো যায় না।’
রাঙ্গুনিয়া সরকারি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এ কে এম সুজাউদ্দীন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘জুট মিলে বর্তমান সময়ে একজন শ্রমিকের দৈনিক বেতন বা মজুরি ২৭০ টাকা থেকে ৩২০ টাকা। বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এ যুগে এই বেতন খুবই কম। আরেকটু বেশি হলে ভালো হতো, তারা পরিবার নিয়ে ভালোভাবে চলতে পারতেন।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার রাঙ্গুনিয়া উপজেলা মডেল শাখার সভাপতি মাওলানা মো. জহুরুল আনোয়ার একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই পরিস্থিতিতে এটা বেতনই না। এ বেতন নূন্যতম একটা মজুরি স্কেলেও তো পড়ে না। এগুলো নিয়ে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক দরকার। যারা সেখানকার শ্রমিক, উক্ত কর্মস্থলের মিল কর্তৃপক্ষ এবং শ্রমিকদের যারা দেখে সরকারের সে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানসহ ত্রিপক্ষীয় একটা আলোচনা করে যুগোপযোগী বেতন স্কেল নির্ধারণ করা দরকার।’