রাজনীতি না করেও আসামি হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় নিহতের ঘটনায় দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক মামলা হচ্ছে। এসব মামলায় এমন কিছু ব্যবসায়ীদের আসামি করা হচ্ছে যাদের রাজনৈতিক কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। যা নিয়ে এরই মধ্যে নানা ধরনের প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। অভিযোগ উঠেছে, চাঁদা, ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ না পাওয়া এবং অনৈতিক সুবিধার জন্যই ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এজন্য বাঁধাগ্রস্ত হতে পারে দেশের অর্থনীতির চালিকা শক্তি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় অর্ধশত ব্যবসায়ীর নামে দেশের বিভিন্ন থানায় মামলা হয়েছে। যেসব অভিযোগে মামলাগুলো দায়ের হয়েছে সেগুলো সম্পর্কে কোনো তথ্য প্রমাণও পাওয়া যায়নি। ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলা নারায়ণগঞ্জেই এমন পাঁচটি মামলার সন্ধান মিলেছে। যাতে আসামি করা হয়েছে অন্তত সাতজন ব্যবসায়ীকে। এর মধ্যে আড়াইহাজার থানায় দায়ের করা দুটি হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে দেশের বৃহৎ রপ্তানিমুখী পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ফকির গ্রুপের তিনজনকে। একই মামলায় আসামি করা হয় ঢাকার বাইরের একজন পরিবহন ব্যবসায়ীকেও।
যাদের নামে মামলা হয়েছে তাঁরা হলেন, ফকির নিটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির আক্তারুজ্জামান ও উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির মাশরিকুজ্জামান নিয়াজ এবং ফকির ফ্যাশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির কামরুজ্জামান নাহিদ। মামলা দুটির এজাহারের বর্ণনা প্রায় একই। দুই এজাহারেই এসব ব্যবসায়ীর নামের ক্রমিকও একই।
বিশ্বস্ত একটি সূত্র বলছে, মামলায় কারা আসামি হবেন আর কারা হবেন না এটা ঠিক করে দেন সংশ্লিষ্ট এলাকার বিএনপি বা দলটির অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতারা। আবার কোথাও কোথাও পরিচিত নেতাকে ব্যবহার করে স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিরাও তাদের প্রতিপক্ষকে মামলায় ফাঁসাচ্ছেন বলে অভিযোগ আছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফকির গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ৫০ হাজারের মতো কর্মী রয়েছেন। তাঁদের তৈরি পোশাক কারখানার ঝুটসহ বিভিন্ন পরিত্যক্ত মালামালের ব্যবসা করে অনেকে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। এটি আগে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা নিয়ন্ত্রণ করতেন। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিএনপির একাধিক পক্ষ এ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্রিয় হয়। একপর্যায়ে আড়াইহাজার এলাকায় প্রভাবশালী বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির একজন নেতা বড় অঙ্কের অর্থ দাবি করে বলেও অভিযোগ আছে।
এ বিষয়ে ফকির ফ্যাশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির কামরুজ্জামান নাহিদ বলেন, ‘আমরা ব্যবসায়ী। আমাদের পরিবার কখনো কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। ব্যবসায়িক সুনাম ক্ষুণ্ন ও হয়রানি করার উদ্দেশ্যে আমাদের হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে। আরও মামলায় জড়ানোর হুমকি–ধমকি দেওয়া হচ্ছে।’
মামলা দুটির মধ্যে একটি হলো বিএনপির কর্মী সফিকুল ইসলাম হত্যা মামলা। তাঁকে গত ১৯ জুলাই কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তাঁর স্ত্রী তাছলিমা আক্তার বাদী হয়ে ২১ আগস্ট আড়াইহাজার থানায় মামলা করেন। ওই মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪৫ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও ১৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে। সেখানে ১০ থেকে ১৩ নম্বর ক্রমিকে এই চার ব্যবসায়ীর নাম উল্লেখ করা হয়। মামলায় এসব ব্যবসায়ীর নাম কে বা কারা দিয়েছেন, সেটা স্বীকার করেননি তাছলিমা আক্তার। তাঁর দাবি, জেনেবুঝেই মামলা করেছেন তিনি।
আড়াইহাজার থানার অপর আরেকটি মামলাটির খোঁজ নিতে গিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। দুপ্তারা ইউনিয়ন বিএনপির সহসভাপতি বাবুল মিয়াকে হত্যার অভিযোগ এনে ২২ আগস্ট মামলাটি করেন ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নুরুল আমিন। এতে বলা হয়, ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সচেতন নাগরিক হিসেবে অংশ নেন বাবুল। সন্ধ্যা সাতটার দিকে বাড়ি ফেরার পথে পূর্বপরিকল্পিতভাবে বাবুল মিয়াকে কালীবাড়ি বাজার থেকে উঠিয়ে নিয়ে দুপ্তারা ঈদগাহ মাঠে হত্যা করা হয়। অথচ বাবুলের মৃত্যুসনদ ও স্বজনদের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি মারা গেছেন ৩ জুন। তাঁর মৃত্যুতে বিএনপির মহাসচিব তখন শোকবার্তাও পাঠিয়েছিলেন।
কেবল এখানেই শেষ নয়, ৩ জুন ৪৯ বছর বয়সী বাবুলের মৃত্যু হয়েছে বলে মৃত্যুসনদ প্রদান করেছে রূপগঞ্জের ভুলতায় এলাকায় অবস্থিত ডিকেএমসি হাসপাতাল লিমিটেড। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, সাজানো মামলা করতে রাজি হয়নি বাবুলের পরিবার। এ কারণে পরিবারটির কাউকে মামলায় সাক্ষীও করা হয়নি। এ বিষয়ে বাবুল মিয়ার স্ত্রীর সাথে কথা বলা যায়নি। তবে বাবুলের বড় ভাই আবদুল বাতেনের স্ত্রী নাসিমা জাফরিন জানান, তাঁর দেবরের হত্যার সঙ্গে জড়িত আছেন ১০ থেকে ১১ জন। কিন্তু মামলায় যাঁরা জড়িত নন, এমন ব্যক্তিদেরও আসামি করা হয়েছে। তাঁরা প্রকৃত অপরাধীদের বিচার চান।
তবে বাবুল হত্যা মামলার বাদী বিএনপির নেতা নুরুল আমিন জানিয়েছেন, দলের সিদ্ধান্তে মামলাটি করা হয়েছে। বাবুলের মৃত্যু হয়েছে ৩ জুন। মামলায় বলা হয়েছে ৪ আগস্ট এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোনো ভুলভ্রান্তি থেকে থাকলে সেটা দেখতে হবে।
এ বিষয়ে আড়াইহাজার থানার ওসি এহসান উল্লাহ বলেন, থানায় অভিযোগ নিয়ে আসায় এজাহার গ্রহণ করা হয়েছে। নিরপরাধ কেউ থেকে থাকলে সেটি তদন্তে বেরিয়ে আসবে।
এই দুই মামলা ছাড়াও ৫ আগস্ট হাফেজ সোলাইমান নিহত হওয়ার ঘটনায় সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় করা মামলায় রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি আরএস নিটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিকেএমইএর সহসভাপতি মোরর্শেদ সারোয়ারকেও আসামি করা হয়।
এ বিষয়ে মোরশেদ সারোয়ার জানান, ‘আমি কখনো রাজনীতিতে জড়িত ছিলাম না। কী কারণে আমাকে এই হত্যা মামলায় জড়ানো হলো, তা বুঝতে পারছি না।’ একইভাবে ফতুল্লা থানার আরেকটি মামলায় আসামি করা হয়েছে ভুঁইগড়ের এসবি স্টাইল লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. শাহজাহানকে। তিনিও একই কথা বলেন।
অন্যদিকে এক বছর আগের একটি মারপিটের ঘটনায় ২৭ আগস্ট নাজমুল ইসলাম রনি নামের একজনসহ আওয়ামী লীগের ১৯৫ জন নেতা-কর্মীর নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও ৪০০ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়েছে। মামলায় ভাই ভাই স্পিনিং মিলের মালিক লাক মিয়াও আসামি। এ ছাড়া ১৯ জুলাই বাড্ডায় তৌফিকুল ইসলাম নিহত হওয়ার ঘটনায় মামলা হয় ২১ আগস্ট। বাড্ডা থানার এ মামলায় ১১৩ জনের নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয়। এর মধ্যে রাজউকের প্রধান নগর–পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম ও উত্তরার ব্যবসায়ী শেখ মো. রুহুল আমিনের নামও রয়েছে। তাঁদের আসামি করার নেপথ্যে রয়েছেন সোনা চোরাচালান ও রাজউকের প্লট জালিয়াতির ঘটনায় আলোচিত হওয়া এক ব্যক্তি।
ব্যবসায়ীদের নামে একের পর এক মামলার বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসানের পর দেশে একধরনের সংকটময় পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে প্রতিশোধমূলক বা উদ্দেশ্যমূলকভাবে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে এমন মামলা হলে সেটাও অপরাধ। এটি ছাত্র–জনতার নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নের সঙ্গে যায় না। এ মামলাগুলোর ক্ষেত্রে প্রত্যেক ব্যক্তিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। কেউ যেন ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত না হন, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। সূত্র: প্রথম আলো