অন্যান্য

রাসেলস ভাইপার : আতঙ্ক নয়, প্রয়োজন সচেতনতা

ম্প্রতি দেশজুড়ে রাসেলস ভাইপার সাপ নিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। নেতিবাচক প্রচারণায় রাসেলস ভাইপার সন্দেহে মানুষের অমানবিক আচরণে পরিবেশ-প্রকৃতি এবং কৃষকের বহুবিধ উপকারী অনেক নির্বিষ সাপও মারা যাচ্ছে।

সাপের প্রতি এমন আচরণে ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাপের বিষয়ে আমাদের আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন ও সাবধান হতে হবে।
জানা যায়, বাংলাদেশে মোট ৭৮ প্রজাতির সাপ রয়েছে। এরমধ্যে ৫২টি বিষহীন ও ২৬টি বিষধর। তবে এই ২৬টি প্রজাতির বিষধর সাপের সবই আমাদের জন্য আশঙ্কাজনক নয়। মাত্র চার প্রজাতি আমাদের জন্য বিপদজনক। এগুলো হচ্ছে গোখরা, কালকেউটে, রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া ও স-স্কেলড ভাইপার সাপ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর সাপে কামড়ানোর ঘটনা ঘটে ৮ হাজারের বেশি। এসব ঘটনায় ২০ শতাংশ ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু হয়ে থাকে। সাপে কাটার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে মে মাস থেকে অক্টোবর মাস অবধি (বর্ষাকালে) এবং জুন মাসে সাপের প্রকোপ থাকে সবচেয়ে বেশি।

বিষধর ও বিষহীন সাপের কামড়ের পার্থক্য
বিষধর সাপের মাথা ত্রিকোণাকার হয়ে থাকে। কিন্তু বিষহীন সাপের মাথা হয় লম্বাটে। বিষধর সাপের গায়ের রঙ উজ্জ্বল ও রঙিন এবং বিষহীন সাপের গায়ের রঙ মেটে হয়ে থাকে।

অন্যদিকে, বিষহীন সাপ কামড়ালে ক্ষতস্থানে অর্ধচন্দ্রাকার ছোট ছোট আঁচড়ের মত অনেকগুলো দাঁতের দাগ দেখা যাবে। কোনো কোনো বিষহীন সাপের জোরালো কামড়ে মাংসও উঠে আসতে পারে। আর যদি ক্ষতস্থানে প্রায় ১ ইঞ্চি জায়গার মধ্যে দুটি দাঁতের স্পষ্ট দাগ বা গর্ত দেখা যায়, তাহলে বুঝতে হবে, বিষধর সাপে কামড়েছে। দাঁতের স্পষ্ট দাগ অনেক সময় একটাও দেখা যায়।

সাপের কামড় থেকে বাঁচতে হলে
১। কিছু সাপ যেমন-গোখরা দিনের উজ্জ্বল আলোয় চোখে ভালো দেখে না। এদের চলাচল ও খাদ্য সংগ্রহের কাজ চলে গোধূলি বেলায়, নয়তো কাকডাকা ভোরে। ফলে এই দুই সময়ে সাপে কাটার ঘটনা বেশি ঘটে। সুতরাং সন্ধ্যা বা ভোরবেলায় অন্ধকার থাকাকালীন সময় অবশ্যই আলো ব্যবহার করুন এবং কোথাও হাত-পা দিতে হলে, জায়গাটাকে আগে ভালো করে দেখে নিন।

২। ক্ষেত-খামারে কৃষি কাজ করার সময়ে পায়ে গামবুট ও হাতে গ্লাবস পড়ে সাবধানে কাজ করতে হবে।

৩। রাতে মেঝেতে শোবেন না ও অন্ধকারে খালি পায়ে চলাফেরা করবেন না। মশারি টানিয়ে ঘুমানো উচিৎ।

৪। বাংলাদেশে সাপে কামড়ানোর ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে থাকে বর্ষাকালে। বর্ষা বা বন্যার সময় সাপের বসবাসের গর্তে পানি প্রবেশ করলে এরা এদের শিকার ইঁদুর-ব্যাঙের পাশাপাশি মানুষের ঘরবাড়ি বা তার আশপাশে আশ্রয় নেয়। এই সময় সাপের কামড়ের সংখ্যা বেড়ে যায়। তাই এই সময় যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।

৫। সাপের মুখোমুখি হলে নিজেকে একদম নিশ্চল ও শান্ত রাখুন। সাপকে কোনোভাবেই উত্তেজিত করবেন না।

৬। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যদি সাপে কামড়ে থাকে তবে আতঙ্কিত না হয়ে দেরি না করে কাছের স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতালে রোগীকে নিয়ে যান।

সাপের কামড়ের চিকিৎসা
সাপে কাটা মানেই নিশ্চিত মৃত্যু নয়। রোগীকে সাহস দিন, আশ্বস্ত করুন এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রোগীকে নিকটস্থ হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে নিয়ে যান। রক্তক্ষরণের জন্য ক্ষতস্থান বা তার আশপাশে কোনোমতেই কাঁটা-ছেঁড়া করবেন না। আক্রান্ত স্থানের কয়েক ইঞ্চি ওপরে ব্যান্ডেজ, বেল্ট বা ছেঁড়া জামাকাপড় দিয়ে হালকা করে বেঁধে ফেলুন।

অ্যান্টিভেনোম প্রয়োগ
আমাদের দেশে এখনও সাপে কামড়ানো রোগীকে হাসপাতালে না নিয়ে বরং ওঝা বা কবিরাজের কাছে নেওয়া হয়। মনে রাখা উচিৎ, সাপে কাটার নির্দিষ্ট, নির্ভরযোগ্য ও একমাত্র ফলপ্রসূ চিকিৎসা হল অ্যান্টিভেনোম দেওয়া। সুতরাং সাপে কাটা রোগীকে অনতিবিলম্বে নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে অ্যান্টিভেনোম দেওয়া উচিৎ। এই চিকিৎসা যত তাড়াতাড়ি করা হবে ততই রোগীর মঙ্গল।

অনেক সময় কামড় দেখে কি ধরনের সাপ কামড়েছে তা বোঝা নাও যেতে পারে। সেক্ষেত্রে রোগীকে অবশ্যই প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পাশাপাশি খুব দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টিভেনোম দিতে হবে।

যদি বিষহীন সাপ কোনো ব্যক্তিকে কামড়ে থাকে এবং সেই ব্যক্তিকে অ্যান্টিভেনোম দেওয়া হয় তাহলে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। অ্যান্টিভেনোম অত্যন্ত নিরাপদ। রোগীর সাধারণ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া যেমন- চুলকানি, চামড়া ফুলে যাওয়া ও লাল হয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো প্রাণঘাতী পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দেওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।

রাসেলস ভাইপার নিয়ে আতঙ্কিত না হবার কথা উল্লেখ করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, জনগণের কাছে এ বার্তা পৌঁছে দিতে হবে যে, রাসেলস ভাইপার নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই। আমি রোগীকে চিকিৎসকের কাছে দ্রুত নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে সংসদ সদস্যদের আহ্বান করেছি। সবাইকে আশ্বস্ত করতে চাই, আমাদের অ্যান্টিভেনোমের সংকট নেই।

পরিবেশবিদরা বলছেন, পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে প্রকৃতিতে সাপের অবদান অনস্বীকার্য। নির্বিচারে সাপ নিধনের ফলে পরিবেশের যথেষ্ট ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। সাপকে বিরক্ত না করলে কিংবা সাপ নিজেকে বিপদগ্রস্ত মনে না করলে, সে কখনও তেড়ে এসে কাউকে আক্রমণ করার নজির নেই। তাই আমাদের নিজেদের স্বার্থেই সচেতন থেকে সাপকে রক্ষা করতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d