শহরে পর্যাপ্ত ত্রাণ, বেহাল যোগাযোগে গ্রামে ‘দুর্দশা’
ফেনীসহ বন্যা উপদ্রুত পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে সড়ক-মহাসড়ক ও শহরকেন্দ্রিক আশ্রয়কেন্দ্রে পর্যাপ্ত ত্রাণ পৌঁছানোর খবরের মধ্যে শত শত গ্রামের তথ্য আসছে, যেখানে ‘বেহাল’ যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে ‘ইচ্ছা’ থাকলেও ত্রাণ নিয়ে যেতে পারা যাচ্ছে না।
ঢাকাসহ সারা দেশ থেকে সরকারি-বেসরকারি ও সামাজিক উদ্যোগে ত্রাণ যাচ্ছে বন্যাকবলিত অঞ্চলে, যেগুলো মূলত শহরকেন্দ্রিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে বন্যার্তদের মাঝে বিতরণ করা হচ্ছে।
রোববারও ফেনীতে প্রচুর পরিমাণে ত্রাণ পৌঁছেছে, যার একটা অংশ সেখান থেকে গেছে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে। তবে ফেনীরই সবচেয়ে বিপর্যপ্ত গ্রামগুলোতে দুর্গম যোগাযোগের কারণে ত্রাণ নিয়ে যাওয়ার প্রতিবন্ধকতার কথা বলছেন স্বেচ্ছাসেবক ও বানভাসি মানুষ।
আশ্রয়কেন্দ্রের বাইরে উঁচু সব বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া মানুষদেরও ত্রাণবঞ্চিত হওয়ার খবর আসছে।
রোববার (২৫ আগস্ট) ফেনী শহরে যাওয়ার পথে কথা হয় সদর উপজেলার ফাজিলপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা শাহাদাত হোসেনের সঙ্গে।তার ভাষায়- অনেকেই ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছেন। তারা আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছেন কিন্তু যারা বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন, তাদের কাছে ত্রাণ পৌঁছাচ্ছে না।
বন্যায় ফেনীর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলা পরশুরাম ও ফুলগাজী। যোগাযোগ সমস্যার কারণে সেখানেও ত্রাণ পৌঁছানো যাচ্ছে না বলে জানিয়ে শাহাদাত বলেন, ত্রাণ আনা হচ্ছে কিন্তু বিতরণের জন্য নৌকা নাই।
সেখান থেকে কিছু দূর এগিয়ে ফাজিলুপর রেলক্রসিং এলাকায় গিয়ে শাহাদাতের দেওয়া তথ্যের মিল পাওয়া গেল।
মুহুরী ব্রিজ-সংলগ্ন রেলক্রসিংয়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে রেললাইনের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন লক্মীণধর দাশ, আব্দুল মালেক, আবু তাহের নামে আরও কয়েকজন।
লক্মীণধরের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ফাজিলপুর ইউনিয়নের শিবপুর জেলেপাড়ায় তার বাড়ি। মুহুরী নদীর তীরে তার বাড়িতে বুধবার সন্ধ্যায় পানি উঠেছে। সহায়-সম্বল ছেড়ে এককাপড়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন বোর্ড অফিসে (ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়)।
আমাদের কাছে ত্রাণ যা এসেছে, সেগুলো শেষ। এখন ত্রাণের জন্য এখানে দাঁড়িয়ে আছি। সবাই এখানে ত্রাণ আনছেন, ভেতরে তো কেউ যাচ্ছেন না।
সেখানেই কথা হয় আব্দুল মালেকের সঙ্গে, যিনি বলেন, স্থানীয় কাদেরীয়া স্কুলে পরিবার নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। সে এলাকায় সকাল থেকে কেউ ত্রাণ নিয়ে যাননি।
রাস্তার কিছু অংশে পানি কমে গেছে, যে কারণে রাস্তার ওপর দিয়ে সেখানে নৌকা নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না জানিয়ে মালেক বলেন, রাস্তা ছাড়া থই থই পানিতে নৌকা চালাতে ভয় পাচ্ছেন বাইরে থেকে আসা স্বেচ্ছাসেবীরা।
ত্রাণ আছে, নৌকা নেই : দুপুরে ফেনীর মুহুরী ব্রিজ এলাকায় দেখা যায় রাস্তার পাশে দাঁড়ানো ত্রাণবোঝাই অনেক ট্রাক। সেগুলো থেকে ত্রাণ নামিয়ে যারা আগে থেকে নৌকার ব্যবস্থা করে রেখেছেন, তাতে তুলে নিয়ে যাচ্ছেন বিভিন্ন গন্তব্যে।
দেখা গেল অনেকেই ত্রাণ নিয়ে অপেক্ষা করছেন, নৌকার অভাবে ট্রাক, পিকআপ থেকে নামাতেও পারছেন না সেগুলো।
খাগড়াছড়ির পানবাজার এলাকা থেকে ত্রাণ নিয়ে পৌঁছেছেন কয়েকজন তরুণ। তাদের একজন দাউদুল ইসলাম।
তিনি বলেন, সকাল ১০টায় আমরা এখানে পৌঁছেছি। শিবপুর এলাকায় বেশকিছু পরিবার প্রতিবেশীদের দ্বিতল, ত্রিতল ভবনে আশ্রয় নিয়েছে বলে জানতে পেরেছি। সেখানে আমাদের ত্রাণ পৌঁছানোর চেষ্টা করছি।
এখন বেলা প্রায় ৩টা, কোনো নৌকা পাচ্ছি না; যে একটি নৌকা পেয়েছি, সেটা তো অতিরিক্ত ভাড়া হাঁকাচ্ছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ত্রাণ নিয়ে এসেছে শিক্ষার্থীদের তিনটি দল। তাদের একজন মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের শাহরিয়ার আহমেদ।
তারা কীভাবে কী করছেন, সেসব নিয়ে কথা হলে তিনি বলেন, আমরা দুই ট্রাকে করে ত্রাণ নিয়ে এসেছি। আবার আরেকটি ট্রাকে করে চট্টগ্রাম শহর থেকে নৌকা ভাড়া করে এনেছি। সেই নৌকা নিয়ে আমরা ত্রাণ দিতে গেছি শিবপুর এলাকায়।
শাহরিয়ার তাদের ত্রাণ বিতরণের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বললেন, বন্যায় যোগাযোগ ব্যবস্থা বেহাল হয়ে পড়ায় শিবপুর এলাকাটি এখন খুব দুর্গম হয়ে আছে; সহজে যাওয়া যাচ্ছে না। সেখানে কয়েকটা বিল্ডিং আছে, কয়েকশ’ লোক ঠাঁই নিয়েছে তাতে।
এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ত্রাণ বিতরণ করতে চাইলেও কেউ পারবেন না। কয়েকটি বাড়িতে আমরা নৌকা থেকে নেমে সাঁতার কেটে গিয়ে ত্রাণ দিয়ে এসেছি।
ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মেজবাহ উদ্দিন।
ফেনীর সন্তান মেজবাহ ফাজিলপুর এলাকায় বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) থেকে বন্যায় আটকে পড়াদের উদ্ধার ও ত্রাণ বিতরণ কাজে যুক্ত রয়েছেন।
তিনি বলেন, বাইরে থেকে বোঝা যাচ্ছে না। এই ফাজিলপুরের শিবপুর, ভূঁইয়ার হাট, বটতলী, কলাতলী, লস্করতালু, মৌটাবি ও নতুন বাজার এলাকার অবস্থা খুব খারাপ। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় সেখানে চাইলেও সহজে যেতে পারছেন না কেউ।
স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতা ছাড়া এসব এলাকায় যাওয়া সম্ভব নয় মন্তব্য করে মেজবাহ বলেন, যারা ত্রাণ নিয়ে আসছেন, তারা স্থানীয় লোকজনকে চেনেন না। আবার অজানা হওয়ায় ভয় থেকেও কথা বলতে চান না; যে কারণে ওইসব এলাকায় পৌঁছানো যাচ্ছে না।
মেজবাহর মতো তথ্য দিলেন সেখানকার আরও কয়েকজন। তাদের ভাষায়- বানের পানি এখনও থই থই করলেও কিছু কিছু জায়গা থেকে ধীরে পানি নামা শুরু করেছে। কোথায় কী আছে, সেটা এখনও বোঝা যাচ্ছে না। ইঞ্জিন-চালিত নৌকা নিয়েও যাওয়া যাচ্ছে না। কোথাও দাঁড় বেয়ে আবার কোথাও ঠেলে ঠেলে নিয়ে যেতে হচ্ছে নৌকা।
বাইরের লোক কীভাবে বুঝবেন চলাচলের পথে কোথায় কী পড়তে পারে, বলেন মেজবাহ।
উদ্ধার ও ত্রাণ বিতরণে নিজেদের নিয়ে যাওয়া নৌকার তলা ফেটে যাওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, নৌকা ঠেলে আনার সময় একটা কালভার্টের সাথে ধাক্কা লেগে আমাদের নৌকার তলা ফুটো হয়ে গেছে। সে নৌকা নিয়ে আরেকটা দল গেছে ভেতরে ত্রাণ বিতরণ করতে। দুই ঘণ্টার মধ্যে তাদের ফিরে আসার কথা, অথচ ছয় ঘণ্টাতেও ফেরেনি। যোগাযোগও করতে পারছি না। তাই তাদের নিয়ে কিছুটা চিন্তায়ও আছি।
বাবা-মা ও ভাই কেমন আছেন, জানেন না ঠাকুর চাঁন : ফাজিলপুর রেলস্টেশনে আশ্রয় হয়েছে ঠাকুর চাঁনের। সেখানে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বললেন, বুধবার দুপুরে দ্রুত বেগে ঘরে পানি চলে আসে। সব কিছু ফেলে এককাপড়ে প্রায় তিন কিলোমিটার হেঁটে পরিবার নিয়ে স্টেশনে চলে আসি।
কিন্তু আমার ষাটোর্ধ্ব বাবা-মা ও বড় ভাই কী অবস্থায় আছেন, সেটা এখনও জানি না।
গত বুধবার থেকে পানিতে চারদিক প্লাবিত হওয়ার পর বিদ্যুৎ ও যোগাযোগহীন হয়ে পড়ে ফেনী। স্বজনদের খোঁজ না পেয়ে অনেকেই উদ্বিগ্ন।
ঠাকুর চাঁন যেমন বললেন, বাবা-মা, ভাই কোথায় আছেন, সেটা পাঁচ দিনেও জানতে পারলাম না।
এরপর কী, দুশ্চিন্তায় মানুষ : বন্যায় প্রাণ বাঁচাতে ঘরবাড়ি ছেড়ে ইচ্ছা-অনিচ্ছার আশ্রয়ের দিন শেষ হলে তারপর কী হবে, সে চিন্তাও ভাবাচ্ছে বানভাসি মানুষকে। যারা বন্যার্তদের জন্য উপদ্রুত অঞ্চলে কাজ করছেন, তারাও বিষয়টি নিয়ে কথা বলছেন।
মেজবাহ উদ্দিনের ভাষ্য, বন্যার পানি পুরোপুরি নেমে যাবার পর যে ভয়ঙ্কর ক্ষত ভেসে উঠবে, তা দেখতে দেশবাসী কতটুকু প্রস্তুত, সেটা এখন দেখার বিষয়।
প্রতিটি ঘরবাড়ি পানির নিচে তলিয়ে গেছে। কারও কোনো সহায়-সম্বল নেই। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে তাদের অনেক প্রতিকূলতা পাড়ি দিতে হবে।
বানভাসি মানুষের চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ। তারাও বলছেন, সাময়িক সময়ের জন্য অনেকে সহায়তা দিচ্ছেন। তবে এই পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়াতে যে আর্থিক সহায়তার প্রয়োজন হবে, সেটা কীভাবে আসবে, কারা দেবে; তা নিয়ে চিন্তা এসেই যাচ্ছে।
ফাজিলপুর রেলস্টেশন-সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা জামাল উদ্দিন দুলাল, কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তার বক্তব্য- নিজের চাষ করা ধান ওঠার পর বছরে কতটা প্রয়োজন হবে, সে হিসাবে রেখে দেন। এবার বানের পানি সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। এককাপড়ে ঘর থেকে বের হয়ে এসেছেন। সামনে কী করবেন, কিছুই মেলাতে পারছেন না আর।
একসময় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করা ঠাকুর চাঁন কয়েক বছর ধরে ফাজিলপুর বাজারে ভ্যানে করে পান বিক্রি করেন।
তিনি বলেন, মানুষের কাছ থেকে ধার করে, সমিতি ও এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে নতুন ঘর তৈরি করেছি। দেড় মাস আগে নতুন ঘরে উঠেছি। এখনও ধারের টাকা পরিশোধ হয়নি। কিন্তু পুরো ঘর পানির তোড়ে ভেঙে গেছে। পানভর্তি ভ্যান ছিল ঘরের সামনে, সেটাও ভাসিয়ে নিয়ে গেছে।
এক কাপড়ে ঘর থেকে বের হয়ে এসেছি। গতকাল (শনিবার) এখানে ত্রাণের কাপড় দেওয়া হয়েছে। সে কাপড় পড়ে আছি এখন। কীভাবে ঋণের টাকা পরিশোধ করব, কীভাবে নতুন ঘর করব; সেটা নিয়েই চিন্তায় আছি।
১৫ দিন আগে সন্তান হারানো মহিউদ্দিনের ঘর ভাঙল বানের তোড়ে : ফাজিলপুর রেলস্টেশন-সংলগ্ন এলাকায় নতুন টিনের ঘর তৈরি করেছিলেন ব্যাটারি-চালিত অটোরিকশা-চালক মহিউদ্দিন। তার ১৮ বছর বয়সি ছেলে রাজমিস্ত্রির জোগালি ছিলেন। দিন পনের আগে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মারা যান তার এই সন্তান।
আর তার তৈরি করা ঘরটিও ভেঙে গেছে বানের তোড়ে।
মহিউদ্দিনের ভাতিজা মো. মোস্তফার সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ফাজিলপুর স্টেশন সম্প্রসারণের জন্য তার চাচা মহিউদ্দিনের জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। সেই সুবাদে গত ছয়-সাত বছর ধরে রেলওয়ে থেকে বন্দবস্তো নেওয়া জায়গায় বসবাস করে আসছেন তারা।
লোকজনের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে ঘর তৈরি করেছিলেন। সে ঘরটাও তার ভেঙে গেছে বানের তোড়ে।