অন্যান্যকক্সবাজার

সামুদ্রিক জীবন নকশায় ফুটিয়ে তুলেছি

যাত্রী সাধারণের ব্যবহারের জন্য আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে খুলে দেওয়া হচ্ছে কক্সবাজার রেলস্টেশন।দৃষ্টিনন্দন স্টেশনটির স্থাপত্য নকশায় ফুটে উঠেছে কক্সবাজারের সামুদ্রিক আবহ।স্টেশনটির নকশা করেছেন ফয়েজ উল্লাহ। স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান ‘ভলিউমজিরো’র প্রধান এই স্থপতির কাছ থেকে স্টেশনটির স্থাপত্য নকশার নেপথ্য ভাবনা জানলেন সামিয়া শারমিন

বাংলাদেশ রেলওয়ের পক্ষ থেকে কক্সবাজার রেলওয়ে স্টেশনের নকশার প্রস্তাব পেয়ে সানন্দেই রাজি হয়ে যাই। কক্সবাজার আমাদের দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যটনস্থান, পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত। এখানে রেলস্টেশন হবে, ভেবেই নিজের ভেতর বাড়তি প্রেরণা কাজ করছিল।

জনপ্রিয় পর্যটনস্থান হিসেবে কক্সবাজারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। কিন্তু আমাদের পছন্দের শহরটাকে আমরা সেভাবে এখনো গোছাতে পারিনি। নকশা করার আগে বারবার তাই মনে হচ্ছিল, কক্সবাজার রেলস্টেশনটি একটা ভালো স্থাপত্য দাবি করে। এখানে যেহেতু তেমন কিছুই হয়নি, তাই একটা সাদা পাতায় কিছু লেখার মতো নকশার কাজ করার সুযোগ পেয়ে গেলাম।

যেকোনো স্টেশন, হতে পারে সেটা বাস, রেল বা বিমান—একটা শহরের প্রবেশদ্বার। তাই অধিকাংশ স্টেশনের নকশাও প্রায় কাছাকাছি হয়ে থাকে। স্টেশনে একটা বড় খোলা জায়গা (কনকোর্স হল) থাকে, যেখান দিয়ে যাত্রীরা ভেতরে প্রবেশ করে বা বের হয়ে অন্য গন্তব্যে যায়। কক্সবাজার রেলস্টেশনের এই ট্রানজিশন স্পেসটি (প্রবেশ ও বের হওয়ার জায়গা) আমরা এমনভাবে তৈরির কথা ভাবলাম, যেন একটি বড় ও বিশেষ ধরনের আচ্ছাদন দিয়ে সেটা ঢেকে রাখা যায়। এই আবরণটি কী দিয়ে হবে, কেমন হবে, ভাবতে থাকলাম। কারণ, এটাই কিন্তু একটা রেলস্টেশনের স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য। এই আবরণ ছাড়া সব স্টেশন, সব টার্মিনালই তো আসলে এক।

কক্সবাজার রেলস্টেশনের ট্রানজিশন স্পেসটা একটা প্রতীক দাবি করে। কারণ, কক্সবাজার একটা জায়গা। সেই জায়গার সঙ্গে স্টেশনটাকে আমরা সংযুক্ত করতে চাই। তখন তাৎক্ষণিকভাবে মাথায় আসে কক্সবাজারের সামুদ্রিক জীবনের কথা, বিশেষ করে ঝিনুক, শামুকের কথা। ঝিনুকের মতো সামুদ্রিক প্রাণীর প্রাকৃতিকভাবেই বহিঃকঙ্কাল থাকে, তার নিচেই কিন্তু দরকারি উপাদানগুলো থাকে। প্রকল্পটিতে আমিও এমনই একটি বহিরাবরণ করতে চাইলাম, যা সামুদ্রিক জীবনকে উপস্থাপন করে, আবার তার নিচে রেলস্টেশনের ফাংশন বা দরকারি বিষয়গুলোকে ধারণ করে। এই জায়গায় আমাদের অনুপ্রেরণা ছিল খোলস-কাঠামো। এই স্থাপত্যের স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য মূলত সেখান থেকেই এসেছে।

একটু আধুনিক রীতির আন্তর্জাতিক ধরনের রেলস্টেশন বা ট্রানজিট পয়েন্ট যেমন হয়, আমরা এখানে তেমনটি করার উদ্যোগ নিই। ট্রান্সপোর্ট অরিয়েন্টেড ডিজাইন (টিওডি) একদমই নতুন একটা ধারণা। স্টেশনের সঙ্গে মানুষের কেনাকাটা, থাকার জায়গা, ব্যাগ রাখার জায়গা, খাওয়ার জায়গা—নানা কিছু সম্পর্কিত। মানুষ ওখানেই থাকতে পারে, ওখানেই ব্যাগ রেখে বের হয়ে যেতে পারে, হয়তো একটা শহরে বা একটা জায়গায় গেল, সে তার ট্রানজিট স্পেস হিসেবে সেখানে ব্যাগ রেখে বাইরে গিয়ে ঘুরে, কাজ করে এসে আবার চলে গেল। কিংবা ওখান থেকে সে আরেক জায়গায় যাবে, সেখানে তিন-চার ঘণ্টা ট্রানজিট করবে। তাহলে তো একটা হোটেল রুম বা রাত কাটানোর ব্যবস্থা থাকতে পারে। আবার কেনাকাটা করতে পারে। আবার আশপাশে যে প্রতিবেশী আছে, তাদের সহায়তা দেওয়ার জন্য কিছু কমিউনিটি কর্মকাণ্ডও এখানে আসতে পারে। যেমন বহুমুখী হল। একটা যথার্থ টিওডির উদাহরণ হচ্ছে কক্সবাজার রেলস্টেশন। আমি নিশ্চিত, এটা সঠিকভাবে যদি ব্যবস্থাপনা করতে পারি, তবে ভবিষতের জন্য একটি ভালো উদাহরণ হয়ে থাকবে।

২০২০ সালে আমরা রেলস্টেশন প্রকল্পটির নকশার কাজ শুরু করি। পুরো প্রকল্পে এডিবির পরামর্শক থেকে শুরু করে বেশ কিছু দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান যুক্ত আছে। প্রতিটা পর্যায়ে, প্রতিটা ধাপে তারা আমাদের নকশা যাচাই করেছে। প্রকল্প নকশা ও ডকুমেন্টেশন করতে করতে এক বছর লেগে যায়, তারপর শুরু হয় নির্মাণকাজ। সেই হিসেবে প্রকল্পটি বেশ দ্রুতই সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্পটির স্থানীয় নির্মাতা প্রতিষ্টান ম্যাক্স গ্রুপও দ্রুত ও সুন্দর নির্মানের জন্য প্রশংসার দাবি রাখে। কমলাপুর রেলস্টেশনের পর আমাদের এখানে আর কোনো আইকনিক রেলস্টেশন হয়নি। সাধারণ মানুষ যে প্রকল্পটিকে গ্রহণ করেছেন, সেই জায়গায় আমরা বেশ উচ্ছ্বসিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d