কক্সবাজারচট্টগ্রাম

সেন্টমার্টিনের পথে কারা কেন গুলি করছে, যা জানা গেল

সেন্টমার্টিনে যাতায়াত নিয়ে বিগত কিছুদিন ধরে আতঙ্ক বিরাজ করছে। সম্প্রতি একাধিক ট্রলারে মিয়ানমার সীমান্ত থেকে গুলি ছোড়া হয়েছে।

ফলে বেশ কিছু দিন ধরে সেন্টমার্টিনে খাবার সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আতঙ্কজনক পরিস্থিতিতে গত ১৩ জুন থেকে কক্সবাজার বিআইডব্লিউটিএ ঘাট থেকে বঙ্গোপসাগর হয়ে বড় ট্রলারে সেন্টমার্টিনে পণ্য সরবরাহ অব্যাহত রাখা হচ্ছে।

ঘটনা ১:
গত ১ জুন বিকেল সাড়ে ৩টায় টেকনাফ পৌরসভার নৌকা ঘাট থেকে ১টি ট্রলার সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে রওনা হয়। ওই ট্রলারে মুদি মালামাল ও ১০ জন যাত্রী ছিল। আনুমানিক বিকাল সাড়ে ৪টার সময় নাইক্ষ্যংদিয়া খাল এলাকা অতিক্রমের সময় আরাকান আর্মি ওই ট্রলার লক্ষ্য করে ৬-৭ রাউন্ড ভারী অস্ত্রে ফায়ার করে। তবে এতে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি এবং ট্রলারটি বিকেল ৫টা ৫৫ মিনিটে সেন্টমার্টিন দ্বীপে নিরাপদে পৌঁছায়।

ঘটনা ২:
গত ৫ জুন সেন্টমার্টিনের জিঞ্জিরায় স্থগিতকৃত একটি কেন্দ্রে টেকনাফ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান পদের ফলাফল নির্ধারণের জন্য ভোটগ্রহণ করা হয়। অনুষ্ঠান শেষে বিকাল ৫টা ৪৫ মিনিটের দিকে দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেট শাফকাত আলির নেতৃত্বে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা টেকনাফের উদ্দেশে রওনা দেন।
মেটাল শার্ক ও কাঠের বোটযোগে মোট ২৭ জন যাত্রী ফিরছিলেন। পথে নাফনদে এবং বঙ্গোপসাগরের মোহনায় নাইক্ষ্যংদিয়া চর এলাকা অতিক্রম করার সময় মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের মেগিচং এলাকা থেকে আরাকান আর্মি গুলিবর্ষণ করে। এতে মেটাল শার্কে ২ রাউন্ড এবং কাঠের বোর্ডে ৪ রাউন্ড গুলি লাগে। পরে ওই বোট এবং মেটাল শার্ক দুটি নিরাপদে টেকনাফ কোস্টগার্ডের বোটপুলে ফিরে আসে।

ঘটনা ৩:
গত ৮ জুন আনুমানিক ১২টার দিকে নাইক্ষ্যংদিয়া খাল সীমান্তে নাফনদের মোহনায় দুটি কাঠের ট্রলার সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে রওনা দেয়। টেকনাফ পৌরসভাস্থ কাউকখালী ঘাট থেকে সিমেন্ট, রড ও ৬ জন যাত্রী নিয়ে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে যাওয়ার পথে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের মেগিচং ক্যাম্পের ওয়াচ টাওয়ার থেকে আরাকান আর্মি আনুমানিক ১৫-২০ রাউন্ড গুলি চালায়। পরে ট্রলার দুটি ১২টা ২৫ মিনিটের দিকে শাহপরীর দ্বীপ জেটিঘাটে ফিরে আসে। এতে ১টি ট্রলারে ৭ রাউন্ড গুলি আঘাত হানে। এ ঘটনায়ও কেউ হতাহত হয়নি।

ঘটনা ৪:
১১ জুন সকাল ১০টা ৩০ মিনিটের দিকে টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের গোলারচরের বিপরীতে মিয়ানমারের নাইক্ষ্যংদিয়া খাল সীমান্তে নাফনদের মোহনা হয়ে একটি স্পিডবোটযোগে সেন্টমার্টিনের ৫ জন স্থানীয় বাঙালি শাহপরীর দ্বীপ জেটি থেকে সেন্টমার্টিনে যাচ্ছিল। পথে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের মেগিচং বিজিপি ক্যাম্পের ওয়াচ টাওয়ার এলাকা থেকে আরাকান আর্মি স্পিডবোটকে লক্ষ্য আনুমানিক ৪-৫ রাউন্ড গুলি করে। এতে স্পিডবোটে অবস্থানরত বাঙালিরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। যদিও কেউ হতাহত হয়নি। পরে ১১টার দিকে স্পিডবোটটি সেন্টমার্টিনে পৌঁছায়।

এসব গুলিবর্ষণের ঘটনাসমূহের কারণে গত কয়েকদিন টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে। ফলে খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে।

জানা গেছে, আনুমানিক প্রায় এক দশক পূর্বে সেন্টমার্টিন দ্বীপ সংলগ্ন স্থানে বঙ্গোপসাগরের মাঝে দুটি স্থানে বালুচর জেগে ওঠে। এই দুটো বালুচরের কারণে ভাটার সময়ে সেন্টমার্টিনে চলাচল করা যাত্রী ও পণ্যবাহী নৌযানগুলো সাগরের ভেতর মিয়ানমারের একটি অংশ ব্যবহার করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে।

মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) সঙ্গে বাংলাদেশের বিজিবির সমন্বয়ের কারণে এই চলাচলে ইতোপূর্বে কখনোই কোনো বাধার সৃষ্টি হয়নি। তবে সাম্প্রতিক অতীতে আরাকান আর্মি মিয়ানমারের এই অঞ্চল দখল করে নেওয়ার কারণে সৃষ্ট সমন্বয়হীনতার সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশের সেন্টমার্টিনগামী ট্রলার ও নৌযানগুলোকে লক্ষ্য করে আরাকান আর্মি গুলি ছুড়ছে। ফলে কর্তৃপক্ষ বাণিজ্যিক ট্রলার ও স্পিডবোট চলাচল সাময়িক স্থগিত করার কারণে সেন্টমার্টিনে বসবাসকারীদের মধ্যে খাদ্য সংকট তৈরি হয়েছে এবং বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা চলছে।

এছাড়া কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপ এলাকায় নাফনদে এবং বঙ্গোপসাগরের মোহনায় গোলারচর নামক এলাকায় আনুমানিক ২ কিলোমিটারজুড়ে বড় একটি বালুর চর রয়েছে। সেই সঙ্গে গোলারচর থেকে আনুমানিক ৫-৭ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরের মধ্যবর্তী স্থানে নাইক্ষ্যংদিয়া নামক স্থানে ১ কিলোমিটারের মধ্যে আরও একটি বালুর চর ভাটার সময় জেগে ওঠে। ফলে টেকনাফ দমদমিয়া কেয়ারি জেটিঘাট থেকে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে যাত্রা করা যাত্রী ও পণ্যবাহী জাহাজ, মাছ ধরার ট্রলার, সার্ভিস বোট এবং স্পিডবোটসহ সব ধরনের নৌযানগুলোকে গমনাগমনের সময় জেগে ওঠা বালুর চরের কারণে ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম বাউন্ডারি লাইনের (আইএমবিএল) মিয়ানমার অংশের নাইক্ষ্যংদিয়া এলাকা ব্যবহার করতে হয়। বর্ণিত চর দুটি ড্রেজিং করা হলে মিয়ানমারের জলসীমা আর ব্যবহারের প্রয়োজন হবে না।

সেন্টমার্টিনের উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ে কাজ করা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারি কর্মকর্তাদের থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

সেন্টমার্টিন দ্বীপে ৮ হাজার ৪৯২ জন বাসিন্দা বসবাস করেন। জেলা ও উপজেলা পর্যায় থেকে খাদ্য বা পণ্য সরবরাহ করা না গেলে এ দ্বীপের বাসিন্দারা খাদ্য সংকটে পড়তে পারেন। কারণ, সেন্টমার্টিনের সাধারণ জনগণ মূলত টেকনাফ থেকে খাদ্যপণ্য নিয়ে সেন্টমার্টিন দ্বীপে জীবনযাপন করেন। সে কারণে সেন্টমার্টিনবাসীর জন্য কক্সবাজার থেকে বড় ট্রলারে খাদ্য ও অন্যান্য পণ্য সরাবরাহ করা হচ্ছে।

এদিকে নৌযান চলাচল স্থগিত এবং খাদ্য সংকটের পাশাপাশি মিয়ানমার নৌবাহিনীর টহল বৃদ্ধি পাওয়ায় দ্বীপটির স্থানীয়দের মধ্যে আতংক বিরাজ করছে। এমতাবস্থায় দ্বীপের স্থানীয়দের আতংকিত না হওয়ার জন্য স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। তবে এ সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য জন্য টেকনাফের সাবরাং টুরিজ্যম ইকো পার্ক সংলগ্ন সাগর উপকূলে একটি জেটি ঘাট নির্মাণ করার দরকার বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।

টেকনাফের সাবরাং ইকো পার্ক বিচ থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপের দূরত্ব আনুমানিক ২৪ কিলোমিটার। অন্যদিকে বর্তমান জেটিঘাট (দমদমিয়া কেয়ারি জেটিঘাট) থেকে সেন্টমার্টিনের দূরত্ব আনুমানিক ৩৪ কিলোমিটার। টেকনাফের সাবরাং টুরিজ্যম ইকো পার্ক সংলগ্ন সাগর উপকূলে জেটি ঘাট নির্মাণ করা হলে সেন্টমার্টিনের সঙ্গে টেকনাফের যোগাযোগ সহজ ও কম সময়ে সম্পন্ন হবে এবং স্থানীয় জেলে, পর্যটক ও সেন্টমার্টিনের স্থানীয় বাসিন্দাদের টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে গমনাগমন কম সময় সাপেক্ষ, সহজ ও নিরাপদ হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d