হজের নিয়মকানুন
বান্দার সঙ্গে আল্লাহর সেতুবন্ধনের উপায় হলো হজ পালন। যার সামর্থ্য আছে তার জন্য হজব্রত পালন ফরজ।
রাসুলে করিম (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি সঠিকভাবে হজ পালন করেন তিনি আগের সব গুনাহ থেকে নিষ্পাপ হয়ে যাবেন। হজের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-
হজের ফরজ ৩টি
১। ইহরাম বাঁধা ২।
উ’কুফে আ’রাফা (আরাফাতের ময়দানে অবস্থান) এবং তাওয়াফুয যিয়ারাত
হজের ওয়াজিব ৬টি
১. ‘সাফা ও মারওয়া’ পাহাড়গুলো মধ্যে ৭ বার সায়ি করা।
২. অকুফে মুযদালিফায় (৯ই জিলহজ) অর্থাৎ সুবহে সাদিক থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত একমুহূর্তের জন্য হলেও অবস্থান করা।
৩. মিনায় তিন শয়তান (জামারাত) সমূহকে পাথর নিক্ষেপ করা।
৪. ‘হজে তামাত্তু’ ও ‘কিবরান’ কারিরা ‘হজ’ সমাপনের জন্য দমে শোকর করা।
৫. এহরাম খোলার পূর্বে মাথার চুল কাটা।
৬. মক্কার বাইরের লোকদের জন্য তাওয়াফে বিদা অর্থাৎ মক্কা থেকে বিদায়কালে তাওয়াফ করা।
এছাড়া আর যে সমস্ত আমল রয়েছে সব সুন্নাত অথবা মুস্তাহাব।
তালবিয়া
‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক, লা-শারীকা-লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল-মুল্ক, লা শারীকালাক। ’
অর্থ: আমি হাজির হে আল্লাহ! আমি উপস্থিত! আপনার ডাকে সাড়া দিতে আমি হাজির। আপনার কোনো অংশীদার নেই। নিঃসন্দেহে সমস্ত প্রশংসা ও সম্পদরাজি আপনার এবং একচ্ছত্র আধিপত্য আপনার। আপনার কোনো অংশীদার নেই।
ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজ
১. সেলাইযুক্ত যে কোনো কাপড় বা জুতা ব্যবহার, এক্ষেত্রে স্পঞ্জ স্যান্ডেলের ব্যবহার করা
২. মস্তক ও মুখমণ্ডল (ইহরামের কাপড়সহ যে কোন কাপড় দ্বারা) ঢাকা
৩. পায়ের পিঠ ঢেকে যায় এমন জুতা পরা
৪. চুলকাটা বা ছিড়ে ফেলা
৫. নখ কাটা
৬. ঘ্রাণযুক্ত তৈল বা আতর লাগানো
৭. স্ত্রীর সঙ্গে সংগম করা
৮. যৌন উত্তেজনামূলক কোনো আচরণ বা কোনো কথা বলা
৯. শিকার করা
১০. ঝগড়া বিবাদ বা যুদ্ধ করা
১১. চুল দাড়িতে চিরুনি বা আঙ্গুলি চালনা করা, যাতে ছেঁড়ার আশঙ্কা থাকে
১২. শরীরে সাবান লাগানো
১৩. উকুন, ছারপোকা, মশা ও মাছিসহ কোনো জীবজন্তু হত্যা করা বা মারা
১৪. কোনো গুনাহের কাজ করা
হজের প্রকার ও নিয়তসমূহ
প্রথম প্রকার হজে ইফরাদ
বর্ণনা: ওমরাহ ব্যতীত শুধু হজের জন্য ইহরাম বাঁধা এবং হজের সঙ্গে ওমরাহকে না মিলানো। (বদলি হজের জন্যও এই হজ)।
নিয়ত: আল্লাহুমা ইন্নী উরীদুল হাজ্জা ফায়াসছির হুলিওয়াতা কাব্বালহুমিনি্ন। (বাংলা নিয়ত- আল্লাহ আমি ইফরাদ হজের উদ্দেশে আপনার সন্তুষ্টির জন্য ইহরাম বাঁধলাম। তা সহজ করে দিন ও কবুল করে নিন)।
দ্বিতীয় প্রকার হজে কিবরান
বর্ণনা: একত্রে একই স্থান থেকে হজ ও ওমরার নিয়ত করে হজের সঙ্গে ওমরাহকে মিলানো এবং একই ইহরামে উভয়টি আদায় করা।
নিয়ত: আল্লাহুমা ইন্নী উরীদুল উ’মরাতা ফায়াচ্ছির লি-ওয়াতাকাব্বাল মিন্নী। (হে আল্লাহ আমি আপনার উদ্দেশে হজে কিবরানের জন্য ইহরাম বাঁধলাম তা সহজ করে দিন ও কবুল করে নিন। )
তৃতীয় প্রকার হজে তামাত্তু
বর্ণনা: একই সফরে পৃথক ভাবে ‘ইহরাম’ পরিধান করে ‘হজ ও ওমরাহ’ আদায় করা। প্রথম ইহরামে ওমরাহর নিয়ত করে তা পালন শেষে চুল কেটে ‘ইহরাম’ খুলে হালাল হয়ে দ্বিতীয়বার নতুন করে হজের নিয়তে ৮ই জিলহজ ‘মক্কা শরীফ’ থেকে হজের জন্য ইহরাম বাঁধা। তামাত্তু করার ইচ্ছা থাকলে প্রথমে ওমরার নিয়ত করে এহরাম বাঁধুন।
হজের নিয়ত
আল্লাহুম্মা ইন্নী উরীদুল হাজ্জা ফায়াচ্ছিরহু-লী অ-তাকাব্বালহু মিন্নী। বাংলা নিয়ত- হে আল্লাহ আমি পবিত্র হজ পালনের জন্য ইহরাম বেঁধে নিয়ত করলাম তা সহজ করে দিন এবং কবুল করে নিন।
তাওয়াফের বিবরণ
হাজীদের সর্বপ্রথম কাজই হলো (তামাত্তু ও ক্বেরান কারিরা) নিজের মালছামান গুছিয়ে রেখে পাক পবিত্র হয়ে মোটেই দেরি না করে ‘হারাম শরিফে’ হাজিরা দেওয়া এবং ‘তাওয়াফ’ করা। ওমরাহ এবং হজের তাওয়াফ ব্যতীত নফল তাওয়াফ ও করা যায়। যেমন- রাসূল (সা.), সাহাবা-আওলিয়া, আহলে বাইত, মা-বাবা, পীর-উস্তাদ ও অন্যান্য মুরুব্বি বা সন্তানদের স্মরণে বা তাদের নামে তাওয়াফ করা।
তাওয়াফের ওয়াজিবসমূহ
১. শরীর পাক-সাফ রাখা, অজু করা। নারীদের হায়েজ নেফাছ অবস্থায় তাওয়াফ করা জায়েজ নাই।
২. ছতর ঢাকা। অর্থাৎ যেটুকু ঢাকা প্রত্যেক পুরুষ-নারীর জন্য ফরজ।
৩. ‘হাতীমে কা’বার’ বাইরে থেকে ‘তাওয়াফ’ করা।
৪. পায়ে হেঁটে ‘তাওয়াফ’ করা। অক্ষম ব্যক্তি হুইল চেয়ারে বসে ‘তাওয়াফ’ করতে পারেন।
৫. ‘হাজের আসওয়াদ’ থেকে শুরু করে ডানদিক দিয়ে ‘তাওয়াফ’ শুরু করা।
৬. এক নাগাড়ে বিরতিহীনভাবে ‘সাতবার চক্কর’ দিয়ে ‘তাওয়াফ’ পূর্ণ করা।
৭. ‘সাত চক্করে’ এক ‘তাওয়াফ’, এটা পূর্ণ হলেই ‘তাওয়াফের’ নামাজ পড়া।
তাওয়াফের সুন্নত কার্যাবলী
১. ‘তাওয়াফে’র শুরুতে ‘হাজারে আসওয়াদ’ এর দিকে মুখ করা।
২. সম্ভব হলে ‘হাজের আসওয়াদ’ চুম্বন করা। নতুবা হাত দ্বারা দূর থেকে ইশারা করা, এবং মুখে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর ওয়ালিল্লাহিল হামদ’ বলা।
৩. ‘হাজের অসওয়াদ’ বরাবর দাঁড়িয়ে তাকবীরে তাহরিমা’র ন্যায় উভয় হাত সিনা পর্যন্ত উঠান।
৪. যে ‘তাওয়াফে’র পরে ‘সাঈ’ আছে তাতে ‘এযতেবা’ করা। অর্থাৎ ইহরামের চাদরের (উপরের অংশের) দুই মাথা ডান বগলের নিচ দিয়ে বাম কাঁধের উপর ফেলে দেওয়া।
৫. ‘সাঈ’ যুক্ত ‘তাওয়াফে’র প্রথম তিন চক্করে ‘রমল’ করা। অর্থাৎ বীরের মতো হেলে দুলে জোর কদমে (একের পর এক পা ফেলে) চলা।
৬. বাকি চার চক্কর সাধারণ গতিতে (ধীরে ধীরে) সম্পন্ন করা।
৭. প্রত্যেক চক্কর তাওয়াফ শেষ করে এবং শেষ চক্করেরও পরে ‘হাজের অসওয়াদ’কে চুম্বন করা। সম্ভব না হলে দূর থেকে ইশারা করে
বিসমিল্লাহে আল্লাহ আকবর ওয়ালিল্লাহিল হামদ’দোয়াটি পাঠ করা এবং ৩ নম্বর নিয়মের ন্যায় দাঁড়িয়ে ইশারা করে ‘তাওয়াফ’ শেষ করা।
তাওয়াফের নিয়ত
আল্লাহুম্মা ইন্নী উরীদু তাওয়াফা বাইতিকাল হারাম ফায়াচ্ছিরহু-লী, ওয়া তাক্বাব্বাল-হু-মিন্নী, সাবাআ’তা আশ্ওয়াতি্বন লিল্লাহি তায়া’লা। বাংলায় নিয়ত- হে আল্লাহ আমি তাওয়াফ পালনের জন্য নিয়ত করলাম।
সায়ির নিয়ম
‘হজ ও ওমরাহ’ ছাড়া নফল ‘তাওয়াফে’র কোনো সায়ি নাই। কারো নামে ওমরাহ করতে হলেও সায়ি করতে হবে। সায়ি অর্থ দৌড়ানো। এটা ‘ছাফা’ পাহাড় থেকে প্রথমে শুরু করতে হবে। ছাফা থেকে মারওয়া। মারওয়া থেকে ছাফায়।
এভাবে সাতবার সায়ির সময় প্রথম তিন চক্কর সবুজ বাতির মাঝের অংশটুকু দৌড়ে দৌড়ে হেলে দুলে যাওয়া সুন্নাত (পুরুষদের জন্য)। পরের চার চক্কর সাধারণ গতিতে সম্পন্ন করতে হবে।
সায়ির সহজ দোয়া
সুবহানাল্লাহি ওয়াল হামদু লিল্লাহি ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার ওয়া লা-হাওলা, ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লাবিল্লাহিল আ’লিয়্যিল আ’যীম, রাবিবগফির ওয়ারহাম ওয়াআনতাল আ-আজ্জুল আকরাম।
সায়ির কুরআনি দোয়া
‘ইন্নাছ ছাফা ওয়াল মারওয়াতা মিন শাআ’ইরিল্লাহ ফামান হাজ্জাল বাইতা আও-ই’ তামারা ফালা জুনাহা আ’লাইহি আইয়াত্ত্বাওয়াফা বিহিমা ওমান তাত্বাওয়াআ খাইরান ফা-ইন্নাল্লাহা শাকিরুন আ’লীম। ’
এ দুই দোয়া সাতবার চক্করের সময় হাঁটতে চলতে পড়তে হবে। পরেরটি না পারলে উপরেরটিই যথেষ্ট হবে।
সূত্র: ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হজ ব্যবস্থাপনা বিভাগের ওয়েবসাইট