আন্তর্জাতিক

হামাসের হাতেই কি নিঃশেষ হবে ইসরায়েল?

হামাস ও ইসরায়েলের চলমান সংঘাতে বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতি ভয়ংকর এক অবস্থানে গিয়ে ঠেকেছে। দৃশ্যতঃ যুদ্ধ ইসরায়েল আর হামাসের মধ্যে মনে হলেও সকল বিশ্বনেতাদের মনেই চাপা এক আতঙ্ক কাজ করছে এ সংঘাতকে কেন্দ্র করে।ইসরায়েলের ওপর ফিলিস্তিনি স্বশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের হঠাৎ করে ঘটানো ঐ নজিরবিহীন হামলার পর, টানা এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে গাজায় যেন এক বর্বর ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করেছে ইসরায়েল। তাদের অব্যাহত বিমান হামলায় গত ৯ দিনে প্রায় আড়াই হাজার গাজাবাসী হয়েছে নিহত, আহত হয়েছে হাজার হাজার। গাজাকে যেন বিরানভূমি না করে তারা থামবেই না। আর এ বর্বর গণহত্যা থামাতে তাই একে একে বহু পরাশক্তির রাষ্ট্র চলে এসেছে ফিলিস্তিনির পক্ষে। অন্যদিকে ইসরায়েলের পাশে রয়েছে তাদের বিরাট পরাশক্তির মিত্রদেশ পশ্চিমারা।

পুরো বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো যেন ধীরে ধীরে দু ভাগে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। দু পক্ষই তাদের ব্যাপক সামরিক শক্তির প্রয়োগ ঘটাতে চাইছে, কিন্তু এর পরিণাম কি হতে পারে? ধীরে ধীরে পুরো বিশ্ব কি জড়িয়ে যাচ্ছে এই ইসরায়েল হামাস সংঘাতে? প্রথমে ফিলিস্তিনের ওপর দশকের পর দশক ধরে চলা অমানবিক নির্যাতনের জবাব দিতে ইসরায়েলের ওপর হামাসের আকস্মিক হামলা, যার জের ধরে ইসরায়েলের চলমান জঘন্য বিধ্বংসী প্রতিশোধ, যা থামার কোনো নামই নিচ্ছে না- এসব কারণে পুরো বিশ্ব কি জড়িয়ে পড়ছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মত কোনো অশুভ দিকে?

যেভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য, রাশিয়াও দলের বাইরে নয়:

গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর যুদ্ধের নামে যা চলছে তা স্রেফ গণফত্যা ছাড়া আর কিছুই নয়। হামলার নামে চলমান এ বর্বর হত্যাকাণ্ডে প্রথম থেকেই ইসরায়েলকে হুঁশিয়ারি দিয়ে এসেছে ইরান। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির-আব্দুল্লাহিয়ান ইসরায়েলকে হুমকি দিয়েছেন এই বলে যে যদি অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডে বোমাবর্ষণ অব্যাহত থাকে তাহলে চলমান এই সংঘাত অন্যান্য ফ্রন্টেও শুরু হতে পারে। আর এর মাধ্যমে তিনি লেবাননের সশস্ত্র প্রতিরোধ গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর দিকে ইঙ্গিত করেন। এছাড়া ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে অবস্থান নেওয়ার জন্য ঐকমত্যে পৌঁছাতে বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ও সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ।

এই দুই প্রেসিডেন্ট টেলিফোনে চলমান হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ নিয়ে কথা বলেছিলেন। এ কথোপকথনে তারা ইসলামী ও আরব দেশগুলোর পাশাপাশি বিশ্বের সকল স্বাধীন জনগণকে নির্যাতিত ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে ইহুদিবাদী শাসকদের অপরাধ থামাতে একটি ঐকমত্য অবস্থানে পৌঁছানোর আহ্বানও জানান।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে লক্ষ্য অর্জনে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ান এবং হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়াহ হামাস একে অপরকে ‘সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে’ একমত হয়েছে। যদিও ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের ওপর আঘাত হানা হামাসের হামলায় ইরানের সম্পৃক্ততা নেই তবুও হামাসকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার আশ্বাসই দিয়েছে ইরান। আর হামাস নেতা হানিয়ার দৃঢ় বিশ্বাস এই যুদ্ধের পরে নতুন এক ইতিহাস রচিত হবে যা অতীতের মতো হবে না।

হানিয়া ছাড়াও ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির আবদুল্লাহিয়ান, কাতারের প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন আব্দুল রহমান বিন জাসিম আল থানির সাথেও দেখা করেছেন চলমান ফিলিস্তিন ও হামাসের এ সংঘাত নিয়ে। সেখান থেকেও ফলপ্রসূ কিছুই আশা করছেন তিনি।

অর্থাৎ, গাজায় ইসরায়েলের নেওয়া পদক্ষেপের ওপর নির্ভর করছে, ইরান ইসরায়েলে কী করবে। আর এদিকে গাজায় ইসরায়েল বর্তমানে কি করছে তা সকলের কাছেই দৃশ্যমান।

এদিকে ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলের সীমান্তে লেবাননের হিজুবল্লাহ দলের সঙ্গে দ্বিতীয় ফ্রন্ট খুলতে পারে ইরান। কারণ, হিজবুল্লাহর প্রতি দীর্ঘদিনের সমর্থন রয়েছে ইরানের। ইসরায়েলকে ফিলিস্তিনবাসী ও গাজায় ঘটানো যুদ্ধাপরাধের জবাব দিতে তারা কেউই ছাড় দেবে না বলেই মনে করছে আন্তর্জাতিক মহল।

ইতোমধ্যেই লেবাননের ভূখণ্ড থেকে ইসরায়েল লক্ষ্য করে অন্তত ২০টি রকেট নিক্ষেপ করেছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামীগোষ্ঠী হামাসের সশস্ত্র শাখা আল-কাশেম বিগ্রেড। গতকালই (১৫ অক্টোবর) আল-কাশেম ব্রিগেডের পাশাপাশি ইরান-সমর্থিত লেবাননের সশস্ত্রগোষ্ঠী হিজবুল্লাহও ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে।

এদিকে রাশিয়ার মত পরাশক্তির দেশও এ সংঘাত নিয়ে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছে। এর মধ্যেই ইসরায়েল-গাজার যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কাছে ভোট চেয়েছে রাশিয়া। ইসরায়েল-হামাস সংঘর্ষ বন্ধের খসড়া প্রস্তাবে ভোট হবে বলে আশা করছে দেশটি। আর এ ভোটে ফলপ্রসূ কিছু না হলে রাশিয়ার সংস্পর্শে এই ইসরায়েল হামাস সংঘাতের পরিণতি কি থেকে কি হয়ে যেতে পারে তা বলাই বাহুল্য। যদিও বর্তমানে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়ার মনোযোগ আছে অন্য দিকে, তবুও এ গণহত্যা কিন্তু তাদের নজর এড়ায়নি। আর চিরশত্রু যুক্তরাষ্ট্রের যেখানে এ সংঘাতে আছে ইসরায়েলের সাথে অতপ্রত সম্পৃক্ততা, সেখানে চাইলেও রাশিয়া এ সংঘাত ভবিষ্যতে এড়িয়ে যাবে না।

ইসরায়েলের প্রতি একের পর এক দেশের ভৎর্সনা আসছেই:

এছাড়াও বিভিন্ন দেশ গাজার ওপর ইসরায়েলের চলমান এ বিভৎস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানাচ্ছে। ইসরায়েলি বর্বরতার বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করছে।

সম্প্রতি ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে চলমান সংঘাতের মধ্যে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা হুমকি দিয়েছে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ কলম্বিয়া। আর এই ঘটনায় কলম্বিয়া ও ইসরায়েলের মধ্যে উত্তেজনার পারদ আরও বেড়েছে।

অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ কয়েকটি পোস্ট করেন কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেট্রো। এর জেরেই দক্ষিণ আমেরিকান এই দেশটির কাছে অস্ত্র রপ্তানি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে ইসরায়েল। এরপরই ইসরায়েলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থগিত করার হুমকি দিয়েছে প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেট্রো। এমনকি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেট্রো বলেছেন, ‘যদি ইসরায়েলের সঙ্গে আমাদের বৈদেশিক সম্পর্ক স্থগিত করতে হয় তবে আমরা তা স্থগিত করব। তারপরও আমরা গণহত্যা সমর্থন করি না।‘ এদিকে মালয়েশিয়াও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের নিন্দা জানাতে পশ্চিমা চাপের কাছে মাথা নত করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশটির প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমও এমন কথাই জানিয়েছেন। একইসঙ্গে হামাসের সঙ্গে মালয়েশিয়ার বিদ্যমান সম্পর্ক অব্যাহত রাখারও ঘোষণা দেন তিনি। ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের নিন্দায় পশ্চিমা চাপের সাথে তিনি একমত নন, হামাসের সঙ্গে মালয়েশিয়ার সম্পর্ক রয়েছে এবং তা অব্যাহত থাকবে এমনটাই জানান তিনি। ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশও। একই সঙ্গে মানবিক বিপর্যয় এড়াতে গাজায় সহায়তা পৌঁছানোর সুযোগ করে দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিও আহ্বান জানিয়েছে দেশটি।

এ বিধ্বংসী যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে বিরাট মদদ দাতা:

পৃষ্ঠার অপরপাশে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মত দেশ। যারা ইসরায়েলের এমন ভয়ংকর গণহত্যাও যেন দেখে দেখছে না, বরং একের পর এক রণতরী পাঠাচ্ছে ইসরায়েলের সহায়তায়। মুখে বলছে গাজাবাসীর মানবিক সহায়তা দরকার কিন্তু অন্তরে বিষের ভাণ্ডার নিয়ে ইসরায়েলকে যুদ্ধের ব্যাপারে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে বেড়াচ্ছে। ইসরায়েলের প্রতি তাদের সমর্থন প্রকাশ করতে বিমান বহনকারী জাহাজ তারাই ইসরায়েলের কাছে নিয়ে গেছে। মার্কিন রণতরী ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ড, একটি মিসাইল ক্রুজার ও চারটি মিসাইল বিধ্বংসী যান পাঠানো হয় ইসরায়েলের সহায়তায়। সামনের দিনগুলোতে ইসরায়েলে আরো অস্ত্র সহায়তা পাঠানো হবে জানিয়ে সম্প্রতি আরও রণতরী পাঠিয়েছে দেশটি। যুক্তরাষ্ট্রের এ যুদ্ধজাহাজ গুলো ইসরায়েল উপকূলে অবস্থান করছে বলে জানা গেছে। নিজ শক্তি ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের এমন পৃষ্ঠপোষকতার সাহসেই ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী বর্তমানে গাজায় চলমান বিমান হামলার সাথে সাথে ভয়াবহ স্থল ও নৌ হামলারও পরিকল্পনা করেছে। কখন এ হামলা শুরু হতে পারে তা না জানলেও শত শত ট্যাংক নিয়ে লাখ লাখ ইসরায়েলি সেনা গাজা সীমান্তে অবস্থান করছে। যে কোনো সময়ই গাজায় স্থল অভিযানে নামতে পারে ইসরায়েলি বাহিনী।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অন্তরে বিষ থাকলেও মুখে ঠিকই ঝরে মধুর বর্ষণ। সম্প্রতি এক ন্সাক্ষাৎকারে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ‘হামাস সকল ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে না’ বলে মন্তব্য করেন। তিনি গাজায় একটি মানবিক করিডোর চালু করার কথা বলেন যাতে মানুষ অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ড থেকে বের হওয়ার সুযোগ পায় এবং সেইসাথে গাজায় খাদ্য ও পানিসহ মানবিক সহায়তা বিতরণের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এছাড়া ইসরায়েলে মার্কিন সেনা মোতায়েনের প্রয়োজন নেই বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। কিন্তু এদিক দিয়ে একের পর এক বিমানভর্তি রণতরী পাঠাচ্ছেন ইসরায়েলে। গত শনিবারও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সাথে ফোনে কথা বলার সময় ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অটুট সমর্থনের কথা জানান তিনি। এতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের দারুণ দ্বিচারিতাি প্রকাশ পায়! মুখে যুদ্ধের বিপক্ষে থেকে ইরানকে যুদ্ধ না জড়াতে সতর্ক করে দিয়ে ইসরায়েলকে অস্ত্র সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন। গাজাবাসীর ওপর ইসরায়েলিদের বর্বর গণহত্যার মত যুদ্ধাপরাধ বন্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না।

মূলত বর্তমানে এ অস্থির বৈশ্বিক পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে থামবে কেউ জানে না। হামাস-ইসরায়েলের এ যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যকে না জড়াতে বললেও তারা যেমন জড়িয়ে যাচ্ছে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্র নিজেও একই কাজ করছে। এর ভবিষ্যত কি? হাজার হাজার বেসামরিক নিরীহ মানুষগুলোকে হত্যা করা হচ্ছে। তাদের দোষটা কোথায়? এভাবে যদি পুরো বিশ্ব ধীরে ধীরে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে যায় এর দায় কি এড়াতে পারবে, হামাস, ইসরায়েল কিংবা যুক্তরাষ্ট্র?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d