চট্টগ্রামস্বাস্থ্য

১০ টাকার টিটেনাস অন্য মোড়কে সাড়ে ৪ হাজার

গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের পেটের অসুখ ডায়রিয়া-কলেরা। আক্রান্ত রোগীকে পটাশিয়াম ক্লোরাইড‍, সোডিয়াম অ্যাসিটেট ও সোডিয়াম ক্লোরাইডের মিশ্রণযুক্ত স্যালাইন দিতে হয় শিরায়। ১০ টাকার টিটেনাস অন্য মোড়কে সাড়ে ৪ হাজার

জীবন রক্ষাকারী এই স্যালাইন বাজারজাত করছে মানহীন কোম্পানি। সম্প্রতি নগরের হাজারী গলিতে অনুমোদনহীন স্যালাইন বিক্রি বন্ধে অভিযান চালায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন।
আভিযানিক দল বলছে, অনুমোদনহীন স্যালাইন বেচাকেনার তথ্য মিলেছে বিভিন্ন অভিযানে।

শুধু স্যালাইন নয়, বিভিন্ন রোগের ভ্যাকসিন, ওরস্যালাইন, গ্যাস্ট্রিক আলসারের ওষুধ, ক্যালসিয়াম ও আয়রণ ট্যাবলেট, প্যারাসিটামল, ভিটামিন ট্যাবলেট, অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ হুবহু নকল হয়ে যাওয়ায় আসলটাই বেছে নেওয়া দুঃসাধ্য। আটা, ময়দা দিয়ে ট্যাবলেট ও ক্যাপসুল বানিয়ে বাজারে ছাড়ছে এক শ্রেণির প্রতারক।

চট্টগ্রামে ওষুধের পাইকারি বাজার হাজারী গলিতে প্রায়ই ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর সহ বিভিন্ন সংস্থার অভিযানে উদ্ধার হয় নকল ও ভেজাল ওষুধ। সেখান থেকে জেলা-উপজেলার ফার্মেসিগুলোতে এসব ওষুধ যায় বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া ব্যক্তি উদ্যোগে কারখানা গড়ে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী তৈরি করছে মানহীন ওষুধ, পাল্টাচ্ছে মোড়ক, মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার তারিখ।

গত ২০ মার্চ মেহেদীবাগ এলাকায় শহীদ মির্জা গলিতে একটি ভবনে নকল ওষুধের কারখানার সন্ধান পায় জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত। সেখানে অভিযান চালিয়ে জব্দ করা হয় বিপুল পরিমাণ নকল ওষুধ। এর মধ্যে রয়েছে Nerve-Dx, Fair Soap, Virogel, Virocon, Vh-Lotion, Uni-Bion, Uni-D3, Uni Vis, J-One, J-Bion, J-Roba, J-Pollen, S-Bole সহ বিভিন্ন ব্রান্ডের ওষুধ।

ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকারী কাট্টলী সার্কেলের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আরাফাত সিদ্দিকী বলেন, লাইসেন্স ছাড়া এজেন্ট পরিচালনা, ওষুধ মজুত ও সরবরাহ, নকল ও ভেজাল ওষুধ মজুত, দামের তারতম্য পাওয়া গেছে সেই কারখানায়।

এর আগে ২০২৩ সালে হাজারী গলিতে দুটি গোডাউনের তালা ভেঙে ও ছয়টি দোকানে অভিযান চালিয়ে ৪০ লাখ টাকার নিষিদ্ধ ওষুধ জব্দ করেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রতীক দত্ত ও আবদুল্লাহ আল মামুন। ২০২২ সালে কোতোয়ালী থানা এলাকার জহুর শপিং সেন্টারে এক ফার্মেসীতে অভিযান চালিয়ে একাধিক কোম্পানির প্রায় ৪ হাজার ভেজাল ওষুধ উদ্ধার করে র‌্যাব। প্যাকেটে বিভিন্ন নামি কোম্পানির স্টিকার লাগিয়ে বাজারে ছাড়া হতো এসব ভেজাল ওষুধ।

২০১৬ সালে র‌্যাব পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত হাজারী গলির ৩১টি দোকানে অভিযান চালিয়ে প্রায় পাঁচ কোটি টাকার আমদানি নিষিদ্ধ, মেয়াদোত্তীর্ণ, ভেজাল ও সরকারি হাসপাতালে সরবরাহ করা ওষুধ জব্দ করে। জরিমানা করা হয় ৫৪ লাখ ২৫ হাজার টাকা। অভিযানে নকল ওষুধ কারখানার দুই কর্মচারীকে তিনমাস করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

জানা গেছে, অনেকদিন ধরেই ওষুধ উৎপাদন বন্ধ রেখেছে কোয়ালিটি, কাফকা, ডক্টর টিমস, রিলায়েন্স এমবি, জেনিথ, কুমুদিনী এবং ইউনিয়ন ফার্মাসিউটিক্যালস। তবে এসব কোম্পানির নাম ব্যবহার করে বাজারে বিক্রি হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক। শুধু উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের নামই নয়, জীবনরক্ষাকারী এই ওষুধগুলোও পুরোপুরি ভেজাল। গোয়েন্দা পুলিশের অভিযানে বেরিয়ে এসেছে এই তথ্য।

পুলিশ জানিয়েছে, একটি চক্র ঢাকার সাভার ও কুমিল্লায় নকল অ্যান্টিবায়োটিক ট্যাবলেট ও ক্যাপসুল তৈরি করে দেশের বিভিন্ন জেলায় কুরিয়ারের মাধ্যমে সরবরাহ করতো। চক্রটি ৮-১০ বছর ধরে এমন প্রতারণা করে আসছিল। তারা বাজারে থাকা ও বাজার থেকে বিলুপ্ত এমন ওষুধের মধ্যে রিলামক্স-৫০০ ট্যাবলেট, মক্সিকফ-২৫০, সিপ্রোটিম-৫০০, এমোক্সিসিলিন, জিম্যাক্স, মোনাস-১০ নকল করে বাজারে ছেড়েছে।

বহুল ব্যবহৃত একমি ল্যাবরেটরিজের মোনাস-১০ এবং ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের মনটেয়ার-১০ (মন্টিলুকাস্ট) নকল উৎপাদন ছাড়াও স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের সেফ-৩ (সেফিক্সিম-২০০ মিলিগ্রাম), সেকলো-২০ (ওমিপ্রাজল), জেনিথ ফার্মাসিউটিক্যালসের ন্যাপ্রোক্সেন প্লাস-৫০০ উৎপাদন করে বাজারে ছেড়েছে চক্রটি। ফার্মেসি মালিকরা অধিক লাভের আসায় আসল ওষুধের নামে নকল ওষুধ বিক্রি করেন।

নকল ভ্যাকসিনও বাজারে

হেপাটাইটিস বি রোগ প্রতিরোধে দেওয়া হয় কোরিয়ান হেপাবিগ ভ্যাকসিন। দেশের বাজারে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার টাকা দামের এই ভ্যাকসিন মাত্র ১০ টাকার টিটেনাস দিয়ে নকল সিল বসিয়ে তৈরি করছে ঢাকার কেরানীগঞ্জের একটি চক্র।

এক্টুপিস সকেট দিয়ে ভিটামিন ডি-৩ ইনজেকশন, জেসন গ্রুপের একট্রোপিন ১০ টাকা দিয়ে কিনে গর্ভবতীদের রেসোগাম পি, ইন্ডিয়ান ড্রাইকিজাম অ্যাম্পুল দিয়ে ক্লোপিকজল, ফ্লুয়ানজল, ডিপথেরিয়া ভ্যাকসিন তৈরি করছে। দাম নেওয়া হচ্ছে কয়েক হাজার টাকা। হেপাটাইটিস-বি ভ্যাকসিন ভেঙে পানি মিশিয়ে জরায়ু ক্যানসার প্রতিরোধক নকল টিকা ‘সারভারিক্স টিএম’ তৈরির কারিগরদের সন্ধানও পেয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ। এসব ওষুধ ব্যবহারে মানুষের জীবনহানির ঘটনাও ঘটছে।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সাবেক এক কর্মকর্তা জানান, বিদেশ থেকে ওষুধ আমদানি করতে হলে নিবন্ধন প্রয়োজন। কিন্তু হাজারি গলির বিভিন্ন ফার্মেসিতে নিবন্ধনহীন বিদেশি ওষুধ বিক্রি করা হয়। জরিমানা দিয়েও বারবার একই অপরাধ করে কতিপয় ব্যবসায়ী। দেশে বছরে উৎপাদন হয় ২৫ হাজার রকমের ওষুধ, এর মধ্যে মাত্র ৪ হাজার ওষুধ পরীক্ষা করে দেখার সামর্থ্য আছে পরীক্ষাগারে। আর এর ২-৩ শতাংশ ওষুধ ভেজাল, নকল বা নিম্নমানের।

অসৎ উদ্দেশ্যে ওষুধের কৃত্রিম সংকট তৈরি করলে, কোনো নকল ওষুধ উৎপাদন ও জ্ঞাতসারে বিক্রি, মজুত, বিতরণ বা বিক্রির উদ্দেশ্যে প্রদর্শন, ভেজাল ওষুধ উৎপাদন, বিক্রি ও মজুতের মতো অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন সাজার বিধান রয়েছে। অপরাধের ধরন অনুযায়ী ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করার ক্ষমতাও রাখা হয়েছে ওষুধ ও কসমেটিক আইনে।

চমেক হাসপাতাল এলাকা, পাথরঘাটা, ফিশারিঘাট, হালিশহর, আনন্দবাজার, কাট্টলী, বাকলিয়া, কালামিয়া বাজার, এক কিলোমিটার, চকবাজারের কাঁচাবাজার, ইপিজেড, কলসি দীঘির পাড়, আকমল আলী রোড, ধুমপাড়া, বেঁড়িবাধ, কাটগড়, পতেঙ্গা, অক্সিজেন এলাকার নির্দিষ্ট কিছু ফার্মেসিতে চলে মেয়াদ মুছে দেওয়া ও নকল ওষুধ।

জেলা প্রশাসন, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও র‌্যাবের অভিযানে অনেক নামিদামি ফার্মেসিতে নানা অনিয়ম ধরা পড়লেও ভেজাল কারবারিদের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না।

নকল ওষুধ যাচাই

প্যানাসিয়া ডট লাইভ (www.panacea.live) নামে একটি ওয়েবসাইট আছে যেখানে গিয়ে আপনি আপনার ওষুধটি যাচাই করতে পারবেন। প্যানাসিয়ার আওতায় থাকা প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট ওষুধের প্রতিটি পাতায় একটি করে আলাদা কোড থাকে। কেনার আগে ওষুধের গায়ে থাকা নির্দিষ্ট কোডটি ‘২৭৭৭’ নম্বরে এসএমএস করে পাঠালে প্যানাসিয়ার ডাটাবেইসে থাকা কোডের সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই যাচাই হবে। আর তাৎক্ষণিকভাবে একটি ফিরতি এসএমএসে জানিয়ে দেওয়া হবে ওষুধটি আসল না নকল।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মো. ফখরুজ্জামান বলেন, নকল ও ভেজাল ওষুধ মজুত ও বিক্রির সঙ্গে কারা জড়িত, সেটা দেখা হচ্ছে। জেলা প্রশাসন নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d