২৭ মার্চ পাকিস্তানিরা ৭০ জনকে গুলি করে হত্যা করে আগ্রাবাদে
২৩ মার্চে থমথমে পরিবেশ। চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রাণ বাঁচাতে গ্রামে ছুটে আসছেন সবাই। আমি সেদিন সকালে ১৫ নম্বর ঘাট থেকে নৌকায় চড়ে কর্ণফুলী হয়ে শহরের অভয়মিত্র ঘাটে নামি। ঘাট থেকে হেঁটে আইস ফ্যাক্টরি রোডে আসি। লোকমুখে শুনি, যুদ্ধের জন্য বাঙালিদের কাছে অস্ত্র বিলি হচ্ছে। আমি গিয়ে কিছুই পেলাম না। হতাশ না হয়ে গেলাম রেলস্টেশনের পাশে, সরকারি অবকাশযাপন কেন্দ্রে। সেখানে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের প্রধান নেতারা ছাত্র ও সাধারণ কর্মীদের মুক্তিযুদ্ধ শুরুর নির্দেশ দিচ্ছেন। আমি মুক্তিযুদ্ধের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীতে যোগ দিলাম।
বীর মুক্তিযোদ্ধা লিয়াকত আলী চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণে একথা বলেন। ১৯৫৫ সালের জানুয়ারিতে তিনি আনোয়ারা উপজেলার এক নম্বর বৈরাগ ইউনিয়নের দক্ষিণ বন্দর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আহামদ হোসেন চৌধুরী ও মাতার নাম মা আনোয়ারা বেগম।
তিনি বলেন, দেওয়ানহাট ফায়ার ব্রিগেড স্টেশনে বড় এক ফুফাত ভাই চাকরি করেন। সেখানে গিয়ে জানতে পারি, ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা ক্যান্টেনমেন্টে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অনেক সেনা সদস্য যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। শুনে হালিশহর ঘেরাও করলেন ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) সদস্যরা। শহর ঘিরে খুঁজে খুঁজে পাকিস্তানি সেনাদের মারলেন। বাঙালিরা তখন ঘিরেছেন চট্টগ্রাম ক্যান্টেনমেন্ট। তাদের দলে, ওখানে আমিও যাই। ২৬ মার্চ রাতে অনেকের সঙ্গে ক্যান্টনমেন্টে খাবার সংগ্রহ করে দিলাম। বঙ্গোপসাগর থেকে পাকিস্তান নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ ‘বাবর’ থেকে শহরে দূরপাল্লার কামানের গোলা ছুড়ছে। বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা লড়ছেন। কামানের গোলায় শহরের আকাশও লাল।
গভীর সমুদ্রের জাহাজ থেকে সেনারা স্পিডবোটে চলে আসে হালিশহরে। রাতেই প্রশিক্ষিত এই সেনারা হালিশহর হয়ে আগ্রাবাদের কর্ণফুলী মার্কেটে রাস্তায় পৌঁছে। এর আগেই বাঙালিরা সড়কে গাছ, টায়ার, নানা বস্তু ফেলে ব্যরিকেড দিয়ে রাখে। নিজেরাও আছেন। পাকিস্তানিরা ফুটপাত ধরে খুব ভোরে অস্ত্র হাতে একটু একটু করে ক্রলিং করে এগুচ্ছে। চিনতে না পেরে বাঙালিরা মনে করলেন, বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি দল। অথচ পুরো দলটি বেলুচ রেজিমেন্টের। আগ্রাবাদ ফায়ার ব্রিগেডের সামনে এসে গুলি ছুড়তে লাগল। প্রশিক্ষিত সেনাদল ফায়ার সার্ভিস ঘেরাও করে ফেলল। নির্দিষ্ট কয়েকজন অস্ত্র হাতে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় গুলি করতে করতে চলে আসছেন। স্টেশনের কর্মকর্তা, কর্মচারীরা সরে পড়তে লাগলেন। পালাতে গিয়ে অনেকে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে আটক হলেন।
লিয়াকত আলী চৌধুরী বলেন, আমি তখন স্টেশনের ভেতরে। আরেকজনের সঙ্গে বুদ্ধি করে বাথরুমে ঢুকে ভেতর থেকে বন্ধ করে দিলাম। ভেন্টিলেটর দিয়ে দেখলাম, বাছ-বিচার না করে আটক করে সবাইকে গাল দিতে দিতে নিচে আনছে বেলুচরা। থাকতে না পেরে আমিও একদলের সঙ্গে নেমে পড়লাম। বুড়োদের ছাড়ল গাল দিয়ে, চড় দিলেও পেটাল না। অল্প বয়সের ছেলেদের মেরে হাত-পা ভেঙে দিল।
২৭ মার্চ আমাদের দিয়েই পথ পরিষ্কার করাল। প্রচ- রোদে পিচঢালা পথে তাদের খালি গায়ে শোয়ানো হলো। দলে ফায়ার ব্রিগেডের স্টেশন অফিসার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা সাধারণ পোশাকে আছেন। আনোয়ারার মাঝেরচরে মাঝে মাঝে পাখি শিকারে যেতেন তিনি। আমাদের ঘরে থাকতেন আমাকে চেনেন। তিনি পরিচয় জানিয়ে বুঝিয়ে সেনাদলের প্রধানের সঙ্গে আলাপ করলেন। তাকে কর্মী নিয়ে ফিরতে অনুমতি দিলেন। তিনি মায়া করে লিয়াকতকেও নিলেন। পরে আটক ৭০ জনকে গুলি করে হত্যা করে।
তিনি বলেন, এরপর আনোয়ারার যুবকদের একটি দলের সাথে ভারতের মিজোরামে গিয়ে দেমাগ্রী ট্রেনিং সেন্টারে চেয়ারম্যান সালেহ আহমদ চৌধুরীর দলের হয়ে মুক্তিসংগ্রামের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি।