৩ শিক্ষার্থীর বিপরীতে ৪ শিক্ষক, কেন বিদ্যালয় ছাড়ছে শিশুরা
ঘড়ির কাঁটায় বেলা ২টা বেজে ৪৩ মিনিট। বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে ঝুলছে তালা। অপর কক্ষ দুটিতে পড়ে আছে বেঞ্চ। তাতে জমেছে ধুলাবালু। আরেকটি কক্ষে বসে চারজন নারী শিক্ষক অপেক্ষা করছেন, কখন আসবে চতুর্থ শ্রেণির একমাত্র ছাত্রটি।
এ চিত্র কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার ১৪৬ নম্বর হাবাসপুর সরকারি বিদ্যালয়ের। গত রোববার গিয়ে ওই চিত্র দেখা যায়। বিদ্যালয়টি কুষ্টিয়া কুমারখালী নন্দলালপুর ইউনিয়নে অবস্থিত।
বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শাহিদা খাতুন জানান, বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩। এর মধ্যে প্রথম শ্রেণিতে একজন, দ্বিতীয় শ্রেণিতে একজন; আর চতুর্থ শ্রেণিতে একজন। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ক্লাস প্রথম শিফটে (সকাল ৯টা–দুপুর ১২টা) হয়। এই শিফটে এদিন (রোববার) কেউ আসেনি। আর দ্বিতীয় শিফটের একমাত্র ছাত্র মজিদের জন্য অপেক্ষা করছেন তাঁরা চারজন।
বিদ্যালয়টি মূলত আবাসন প্রকল্পের শিশুদের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এখানে চলাচলের একমাত্র রাস্তাটি মাটির তৈরি। আবার কয়েকটি ইটভাটার যানবাহন চলায় রাস্তার অবস্থা আরও খারাপ। কোনো পরিবহন চলে না। মূলত যোগাযোগব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় আবাসন প্রকল্পের মানুষ অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। পরিবারের সঙ্গে শিশুরাও চলে যাচ্ছে। সে জন্য বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কমে গেছে।
সাদিয়া আক্তার নামের আরেক সহকারী শিক্ষক বলেন, ‘শিক্ষার্থীরাই বিদ্যালয়ের প্রাণ। শিক্ষার্থী না থাকায় প্রাণহীন বিদ্যালয়ে মন বসে না আমার। হয় যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি করা হোক, না হয় তাঁদের পার্শ্ববর্তী অন্য বিদ্যালয়ে সংযুক্ত করা হোক।’
বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ‘১৫০০ বিদ্যালয়’ প্রকল্পের নামে সারা দেশে ১ হাজার ৫০০টি বিদ্যালয় স্থাপন করে সরকার। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালে হাবাসপুর আবাসন প্রকল্পে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ করা হয়। প্রায় ২০ লাখ ৭১ হাজার টাকা ব্যয়ে বিদ্যালয়ের নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন করে উপজেলা প্রকৌশলী কার্যালয় (এলজিইডি)। ২০১৪ সালে বিদ্যালয়ে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ২৬। ২০২৩ সালের শুরুতে ১৪ জন শিক্ষার্থী থাকলেও বছর শেষে তা দাঁড়ায় ৬ জনে। চলতি বছর শিক্ষার্থী রয়েছে মাত্র তিনজন। আর শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক রয়েছেন চারজন। এমন অনেক দিন যায় যে বিদ্যালয়ে কোনো শিক্ষার্থী আসে না। শিক্ষার্থী না থাকায় শিক্ষকেরাও যাওয়া–আসা করেন ইচ্ছেমতো।
কুষ্টিয়া-রাজবাড়ী আঞ্চলিক মহাসড়ক থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে গড়াই নদের তীরে ২০০১ সালে সরকারিভাবে হাবাসপুর আবাসন প্রকল্পে ঘর নির্মাণ করা হয়। প্রথমে ১২০টি এবং পরে আরও ৮০টি ঘর নির্মাণ করা হয়। সেখানে অসহায় ও ভূমিহীন ২০০টি পরিবার বসবাস শুরু করে। দীর্ঘদিন ধরে আবাসনের ঘরগুলো মেরামতের অভাবে জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। অধিকাংশ ঘরে নেই চালা। অকেজো স্যানিটেশন ব্যবস্থা ও নলকূপ। চলাচলের একমাত্র সড়কটিও কাঁচা। সড়কে শুষ্ক মৌসুমে ধুলাবালু ও বর্ষার সময় থাকে হাঁটুসমান কাদা। বর্তমানে ৫২টি পরিবার সেখানে বসবাস করছে।
আবাসন প্রকল্প ঘুরে দেখা যায়, প্রায় দেড় শ ঘরে নেই চালা ও বেড়া। সেখানে পশুপাখি পালন করা হচ্ছে। অকেজো স্যানিটেশন ব্যবস্থা। ১২টি নলকূপের ১০টিই অকেজো।
এ সময় কথা হয় চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র আবদুল মজিদের সঙ্গে। সে জানায়, বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী নেই। একা একা বিদ্যালয়ে যেতে ভালো লাগে না। সে জন্য এদিন (রোববার) সে বিদ্যালয়ে যায়নি।
মজিদের মা মর্জিনা খাতুন জানান, আবাসনে যাতায়াতের রাস্তা ভালো নয়। ভাঙাচোরা ঘরবাড়ি ফেলে অনেকেই শহরে বা গ্রামে চলে গেছেন। বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রী নেই। শিক্ষকেরা প্রতিদিনই আসেন এবং বসে থেকে চলে যান।
আবাসনের বয়োজ্যেষ্ঠ বাসিন্দা উকিল শেখ। তিনি দিনমজুরের কাজ করেন। তিনি বলেন, ‘রাস্তাঘাট ভালো না। গাড়িঘোড়া চলে না। কাজে-কামে যাতি পারে না মানুষ। ঘরবাড়িও ভাঙা। সে জন্য দিনে দিনে মানুষ আবাসন ছেড়ে চলে যাচ্ছে।’ তিনি আবাসন সংস্কার ও সড়কটি পাকা করার দাবি জানান।
হাবাসপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) রোকসানা খাতুন জানান, তিনি ২০১৮ সাল থেকে বিদ্যালয়টিতে কর্মরত। শুরুতে ২৫ জন থাকলেও বর্তমানে মাত্র ৩ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। আবাসনে লোকজন কমে যাওয়ায় বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কমে গেছে। তিনি বিদ্যালয়টিকে অন্য বিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্তির দাবি জানান।
কোনো বিদ্যালয়ে ৫০ জনের কম শিক্ষার্থী থাকলে সেই বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পার্শ্ববর্তী বিদ্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়। তবে এটি আবাসন প্রকল্পের বিদ্যালয় বলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ পর্যবেক্ষণে রেখেছে বলে জানান উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান।
সংস্কার নয়, বরং হাবাসপুর আবাসনে একক পরিবারভিত্তিক ৭০টি ঘর নির্মাণ করা হবে বলে জানান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এস এম মিকাইল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে ৭০টি ঘর নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বরাদ্দ না থাকায় এখনই সড়ক সংস্কার করা সম্ভব হচ্ছে না। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী বাড়ানো ও সড়ক নির্মাণের জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ চলছে।’