আনোয়ারাচট্টগ্রাম

ভাঙন এলাকায় বালু উত্তোলন, ঝুঁকিতে ঘরবাড়ি

চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার জুঁইদন্ডী ইউনিয়নে সাঙ্গু নদী থেকে ড্রেজার দিয়ে অবৈধভাবে বালু তোলা হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে ওই এলাকা থেকে বালু তোলা হচ্ছে। এভাবে বালু তোলায় ওই এলাকায় ভয়াবহ ভাঙন শুরু হয়েছে।

বর্ষা মৌসুমে নদীর তীরবর্তী ফসলি জমি, ঘরবাড়ি ছাড়াও জুঁইদন্ডী ইউনিয়নে প্রায় ১৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নদী গর্ভে বিলিন হওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এই বালু উত্তোলনকারীরা প্রভাবশালী হওয়ায় প্রকাশ্যে কেউ কিছু বলতেও সাহস পান না।

ভাঙনকবলিত এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় ১০০ মিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে নদীতে তলিয়ে গেছে। জোয়ারের পানি প্রবেশ করছে বসতঘর ও কৃষি জমিতে। কয়েকটি বসতঘর ভেঙে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।

স্থানীয়রা জানান, জুঁইদন্ডী ইউনিয়নের প্রায় ১৪ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সাঙ্গু নদী। এর মধ্যে বেড়িবাঁধের সাড়ে তিন কিলোমিটার অংশে ব্লক বসালেও বাকি অংশে মাটি দিয়ে নির্মিত হয়েছে বাঁধ। সম্প্রতি নদী থেকে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলনের কারণে এই ইউনিয়নের বানুরহাট থেকে গোদারপাড় পর্যন্ত দুই কিলোমিটার, মধ্যম জুঁইদন্ডী থেকে পূর্ব জুঁইদন্ডী তিন কিলোমিটার ও হাজি বাজার থেকে রব্বান নিয়াজী বাড়ি পর্যন্ত এক কিলোমিটার অংশে ভাঙন দেখা দিয়েছে।

এলাকাবাসী জানান, স্থানীয় প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা সাঙ্গু নদী থেকে প্রায় ৩ মাস ধরে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছেন। কিন্তু এজন্য তাদের কোনো অনুমতি দেয়নি সরকার। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমের পরই নদীতে ড্রেজার বসিয়ে বালু বিক্রি করে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বালুদস্যু চক্রটি। সারা বছর প্রকাশ্যে ড্রেজার চলে। কখনো কখনো প্রশাসনের ভয়ে দিনে পাইপ খুলে রাখে, রাতে আবার বালু উত্তোলন চলে।

এদিকে বালু উত্তোলনের কারণে কৃষি জমি, বসতবাড়ি ও বেড়িবাঁধ হুমকির মুখে পড়েছে। বর্ষা মৌসুম এলে নদীর পাড়ে ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়। এতে তাদের ঘর সরিয়ে নিতে হয়। গত কয়েক বছরের নদী ভাঙনের কারণে অনেক পরিবারের বাড়ি নদীর গর্ভে তলিয়ে যায়। এতে তারা নিঃস্ব হয়ে ভাড়া ঘরে কোনো রকমে বসবাস করছেন।

সরেজমিনে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে রুবেল ও আবছার নামে দুই ব্যক্তি জুঁইদন্ডী ইউনিয়নের ১ নম্বর ও ২ নম্বর ওয়ার্ডে বেড়িবাঁধের পাশে ড্রেজার বসিয়ে দিনরাত বালু উত্তোলন করে যাচ্ছেন।

স্থানীয় বাসিন্দা শাহাদাত হোসেন বলেন, ড্রেজার দিয়ে রাতদিন সমানে বালু তুলছেন কয়েকজন নামধারী আওয়ামী লীগ নেতা। আমরা গরীব মানুষ তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পাই না। সরকার বাঁধের পাশের জিও ব্যাগ ও বালুর বস্তা দিলেও নদী থেকে বালু তুলে নেওয়ার কারণে তা ফের নদী গর্ভে তলিয়ে যাচ্ছে। ভাঙনের ফলে এখন আমার ঘরের একাংশ ভাঙনের কবলে।

জোবায়দা খাতুনের বয়স ষাটোর্ধ। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আমার কোনো পুত্র সন্তান নেই। দুই মেয়ে আছে। বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। সম্বল হিসেবে স্বামীর রেখে যাওয়া ঘরটি ছিল। এই এলাকায় যখন বাঁধ নির্মাণ হচ্ছিল আশায় বুক বেঁধে ছিলাম, হয়তো স্বামীর রেখে যাওয়া শেষ সম্বলটি রক্ষা হবে। কিন্তু এখন বাঁধ নির্মাণ হওয়ার পরেও বাঁধ ভেঙ্গে ঘরটিও তলিয়ে যাচ্ছে। হয়তো আর রক্ষা হবে না স্বামীর রেখে যাওয়া সম্বলটি। রাতদিন ড্রেজারের মেশিনের শব্দে এই ভাঙা ঘরে থাকা দায়।

বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত মো. আবছার একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘বালু তো আমি একা তুলি না, আরও অনেকে তুলে। আমরা তো বরুমছড়া অংশে তুলি। জুঁইদন্ডী অংশে আব্বাস আর গফুর তুলে।’

অভিযোগের বিষয়ে মো. আব্বাস বলেন, ‘আমরা সাঙ্গু নদী থেকে বালু তুলি না। আমরা বালু বাইরে থেকে এনে এখানে আনলোড করে রাখি। এরপরও আমাদের অনেক জরিমানা করেছে প্রশাসন। কিন্তু যাদের কারণে ভাঙন সৃষ্টি হচ্ছে তাদের তো এখন পর্যন্ত কোনো জরিমানা করা হয়নি।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী শওকত ইবনে সাহীদ বলেন, ‘বিষয়টি আমি অবগত আছি। নদী থেকে বালু উত্তোলনের কারণে বেড়িবাঁধের জিও ব্যাগগুলো সরে বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। আমাদের তো ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা নেই। বিষয়টি আমি আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানিয়েছি। তিনি দেখবেন বলেছেন।’

জানতে চাইলে আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইশতিয়াক ইমন বলেন, ‘সাঙ্গু নদী থেকে অবৈধভাবে ড্রেজার দিয়ে বালু তোলার বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। বালু উত্তোলনকারীদের অনেকবার জরিমানা করা হয়েছে। নতুন করে বালু তোলার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d