লুট হয়ে যাচ্ছে সোমেশ্বরী নদী
লুট হয়ে যাচ্ছে সোমেশ্বরী নদী। এতকাল দখল, দূষণ—এসব শব্দের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল নানা নদীর নাম। কিন্তু পাহাড়ি খরস্রোতা সোমেশ্বরীর দশা দেখে মনে হলো শুধু দখল–দূষণ নয়, দুর্বিনীত তাণ্ডব চলছে তার বুকে। নেত্রকোনার বিরিশিরির বটতলা মোড়ে সোমেশ্বরীর পাড়ে দাঁড়ালেই চোখে পড়ে এর ক্ষতবিক্ষত চেহারা।
ইজারা নিয়ে নদী থেকে বালু তুলছে ক্ষমতাসীন দলের লোকেরাই। কিন্তু মানা হচ্ছে না ইজারার শর্ত। এককালের চোখজুড়ানো এই নদী রক্ষায় কারও কোনো কার্যকর উদ্যোগও নেই।
শত শত ‘বাংলা ড্রেজারের’ (অননুমোদিত ড্রেজার) কানফাটানো বিকট শব্দ ছড়িয়ে পড়ছে নদীর দুই পাশের প্রায় এক-দেড় কিলোমিটার এলাকায়। দূষিত পরিবেশ। দুর্বিষহ পরিস্থিতি। ক্ষতবিক্ষত সোমেশ্বরীর পাড়ে কিছুক্ষণ দাঁড়ালে কানে প্রায় তালা লেগে যায়। নদীর বুক খুঁড়ে প্রতিদিন তুলে নেওয়া হচ্ছে হাজার হাজার ট্রাক বালু, নুড়ি পাথর আর কয়লা।
বালু তোলার শ্রমিক, ট্রাকচালক আর ইজারাদারের তদারকিতে নিয়োজিত লোকেরা ছাড়া অন্যদের নদীর আশপাশে তেমন দেখা যায় না। সোমেশ্বরীর সৌন্দর্য দেখতে বেড়াতে আসেন না কেউ আর। যে সোমেশ্বরীর পাড় একসময় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা সৌন্দর্যপিপাসু পর্যটকের উপস্থিতিতে প্রাণবন্ত হয়ে উঠত, তার পাড় এখন পাহারা দেয় বালুদস্যুদের নিয়োজিত বিশেষ বাহিনী।
এক যে ছিল পাহাড়ি স্রোতস্বিনী
সোমেশ্বরীর খ্যাতি ছিল তার অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর বিরল প্রজাতির মহাশোল মাছসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণীর জন্য। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড়ে জন্ম সোমেশ্বরীর। উত্তর ও পূর্ব দিকে দূরে ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে চলে গেছে গারো পাহাড়ের সারি। নিরিবিলি পাহাড়ি প্রকৃতির কোলজুড়ে এককালে ছুটে যেত স্বচ্ছ সলিলা সোমেশ্বরী।
গারো পাহাড়ের ঢাল বেয়ে প্রবল বেগে নেমে এসে সোমেশ্বরী বাংলাদেশের সমতলে প্রবেশ করেছে নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলায়। দুর্গাপুর থেকে হয়ে জারিয়া, বাঞ্জাইল বাজারের পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মিশেছে কংস নদে।
স্থানীয় জেলেদের জীবিকার প্রধান উৎস ছিল সোমেশ্বরীতে মাছ ধরা। তা ছাড়া দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেক পর্যটক আসত। পর্যটনও আয়ের একটি অন্যতম উৎস ছিল স্থানীয় বাসিন্দাদের। পাহাড় থেকে নেমে আসায় সোমেশ্বরীর খরস্রোত বহু শতবর্ষ ধরে বয়ে আনত বালু আর নুড়িপাথর। এই বালু আর পাথরই নদীটির কাল হলো অবশেষে।
গত বুধবার দুর্গাপুরের বাবুইপাড়ার মাঝি নয়ন মিয়া তাঁর ডিঙি নিয়ে অপেক্ষা করছিল বিজিবির ঘাটে। কোনো যাত্রী নেই। নয়ন বলছিলেন, লোকজন এখন আর এদিকে আসেন না। বেশির ভাগ দিনমজুরি করেন।
নদী নয়, কেবলই বালুমহাল
সরকার সোমেশ্বরী নদীকে বালুমহাল পরিচিতি দিয়েছে। নদীর নাব্যতা বজায় রাখার জন্য ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বালু তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ২০০৫ সালে। কালক্রমে বালুদস্যুরা ড্রেজিংকে নদী লুটের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে।
গত বুধবার দুর্গাপুর থেকে সোমেশ্বরীর বাংলাদেশের প্রবেশমুখ পর্যন্ত ঘুরে যে দৃশ্য দেখা গেল, লিখে তার বাস্তবতা প্রকাশ করা কঠিন। ইজারা দেওয়া পাঁচটি বালুমহালের আয়তন প্রায় দুই হাজার একর। নদীর প্রায় ২২ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে দেখা গেছে বালু পরিবহন ও বালু তুলে নদীকে নিঃ
দুর্গাপুরের শ্যামগঞ্জ থেকে পথের দুই ধারে খানিক পরপরই চোখে পড়ে টিলার মতো বালুর স্তূপ। এসব বালু বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হয় ট্রাকে করে। কোথাও কোথাও বিশেষ ধরনের যন্ত্রে বালু থেকে নুড়িপাথর আর কয়লা আলাদা করা হচ্ছে। যন্ত্রের ঘর্ঘর শব্দ আর ট্রাকের আওয়াজ খনখন করে দিচ্ছে গ্রামীণ পরিবেশের নীরবতা।
নদী থেকে ‘বালু তোলা’ শব্দটির বদলে ‘বালু লুট’ কথাটিই বাস্তবতার সঙ্গে মানানসই। সেই দৃশ্য চোখে পড়ল বিরিশিরি সেতুর ওপরে দাঁড়িয়ে। উত্তর থেকে দক্ষিণে বয়ে যাওয়া সোমেশ্বরীর চওড়া বুকে প্রবাহ এখন সরু খালের মতো। পুরো নদীতে শত শত বাংলা ড্রেজার বসিয়ে চলছে বালু তোলা। বাঁশের খুঁটির ওপরে মাচান বেঁধে বসানো হয়েছে শ্যালো মেশিন আর ছাঁকার যন্ত্র। নদী থেকে বালু উঠিয়ে ট্রাকে তোলা হচ্ছে। শত শত বাংলা ড্রেজার বসানো হয়েছে। প্রতিটি ড্রেজার প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০ টন বালু ও পাথর তুলতে পারে। সারা দিন সারা রাত অবিরত চলছে এই কাজ।
ড্রেজার বসানোর জন্য ফেলা রাখা হয়েছে অসংখ্য বাঁশ। ড্রেজারগুলো এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সরিয়ে নিতে নতুন করে খুঁটি পোতার জন্য এসব বাঁশ ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এগুলো পরে আর সরানো হয় না। বাঁশগুলো নদীতেই থেকে যায়, যা পরে নৌচলাচল ও মাছ ধরার জন্য জাল পাতার ক্ষেত্রে মারাত্মক সমস্যা সৃষ্ট করছে বলে জানালেন দেবথৈল গ্রামের বাসিন্দা হারুন সাংমাসহ অনেকে। এ ছাড়া ড্রেজারের তেল গিয়ে মেশে নদীর পানিতে। তাতে দূষিত হচ্ছে পানি।