‘লাদেন গুহা’য় গাদাগাদি বাস, সমস্যার শেষ নেই সূর্যসেন হলে
তিনটি কক্ষ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারদা সূর্যসেন হলের গণরুম। ১৭৭, ১৭৮ ও ১৭৯ নম্বর কক্ষ নিয়ে এই গণরুম। চারদিক বদ্ধ থাকায় দিনেও বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালিয়ে রাখতে হয়। ধুলাবালি, ময়লা, কয়েক বছর পুরোনো অপরিষ্কার বিছানার অস্বাস্থ্যকর এ পরিবেশেই থাকছেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের কাছে এই গণরুম পরিচিত ‘লাদেন গুহা’ নামে।
হল সূত্রে জানা যায়, একসময় কক্ষগুলো ডাইনিংয়ের স্টোররুম ছিল, যেখানে রান্নার হাড়ি-পাতিলসহ বিভিন্ন কিছু রাখা হতো। তবে পরিত্যক্ত হওয়ার পর এটিকে গণরুম বানিয়ে নেন ছাত্রলীগ নেতারা। এতে মেঝেতে বিছানা পেতে থাকেন প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা।
সরেজমিনে দেখা যায়, ১৭৭ ও ১৭৮ নম্বর কক্ষ মিলিয়ে থাকছেন ১৫ জনেরও বেশি শিক্ষার্থী। অথচ যেখানে খুপরির মতো একটি কক্ষে চারজনের থাকাই কষ্টকর।
শিক্ষার্থীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৭৯ নম্বর কক্ষে গত বছরও প্রথম বর্ষের ৪০ এর বেশি শিক্ষার্থী ছিল। তবে এ বছর ভর্তির সময় আসন কমানো ও নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক সংঘাতের ভয়ে খুব বেশি শিক্ষার্থী হলে ওঠেননি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিক্ষার্থী জানান, লাদেন গুহায় মাঝে মাঝেই অপরিচিত অনেকে এসে থাকেন। দরজা না থাকায় নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়। তাছাড়া চারপাশে বালু-ময়লা পড়ে থাকে। বিছানা ও কাঁথাগুলো গত দেড় দুইবছর থেকে অপরিষ্কার পড়ে আছে। ফলে এখানে থাকলে চুলকানিসহ নানা শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, শুধু লাদেন গুহাই নয়, সূর্যসেন হলে ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত এ রকম ২০টি কক্ষ গণরুম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যেখানে প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষ মিলে দুই শতাধিক শিক্ষার্থী থাকেন।
১৭৭, ১৭৮, ১৭৯, ২০১(ক), ২২৬, ২২৬ (ক), ২৪৯, ৩০১ (ক), ৩২৬, ৩২৬ (ক), ৩৪৯ , ৪০১, ৪২৬, ৪২৬ (ক), ৪৪৯, ৫০১, ৫০১ (ক), ৫২৬,৫২৬ (ক) ৫৪৯, ৬২৬ নম্বর কক্ষ গণরুম হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সাদ্দাম হোসেন, সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান ও ঢাবি শাখার সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন, সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতের অনুসারী পদপ্রত্যাশীরা কক্ষগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেন, শুরু থেকেই আমরা পূর্ণ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি জানিয়ে আসছি। শিক্ষার্থীরা ভর্তি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার একটি রেজিস্ট্রেশন নম্বর, আইডি কার্ড, লাইব্রেরি কার্ড যেমন থাকবে তেমনি একটি রুম ও সিট নম্বর থাকবে। ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাস্টারপ্ল্যান নিয়েছে। সেটি বাস্তবায়ন করে আমরা আবাসন সংকট নিরসনের জোর দাবি জানাচ্ছি।
২০২১-২২ সালের বার্ষিক বিবরণী অনুযায়ী, আবাসিক, দ্বৈতাবাসিক ও অনাবাসিকসহ সূর্যসেন হলের মোট শিক্ষার্থী ১ হাজার ৮৫১ জন। তবে এখানে আবাসিক ও দ্বৈতাবাসিক মিলিয়ে সর্বমোট সিট রয়েছে ১ হাজার ৮৬টি। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের রুম দখল, মাস্টার্স শেষ হওয়ার পরও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় হলে থাকাসহ নানা কারণে সিটের প্রকৃত সংখ্যা আরও কম।
হল অফিস সূত্রে জানা যায়, সিট সংখ্যা ১ হাজার ৮৬ হলেও গণরুমসহ সবমিলিয়ে ১ হাজার ৬০০-এর বেশি শিক্ষার্থী হলে থাকেন।
শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকটের পাশাপাশি সূর্যসেন হলের ক্যান্টিনের অবস্থাও ভালো নয়। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, একে তো খাবারের মান ভালো না, তার ওপর পরিবেশও স্বাস্থ্যকর নয়।
হলের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আদনান জোবায়ের বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য হলের তুলনায় সূর্যসেন হলের খাবারের মান খারাপ। একইসঙ্গে এখানকার পরিবেশও ভালো নয়। বেসিনে হাত ধুতে গেলে বমি চলে আসে। তাই আমি হলে খাবার খাই না।
সূর্যসেন হলের পাঠকক্ষেও আসন সংকট রয়েছে। তিনটি পাঠকক্ষে আসন সংখ্যা প্রায় ২৩০টি হলেও এখানে নিয়মিত শিক্ষার্থীরা পড়তে পারেন খুব কমই। সিনিয়রদের অনেকেই বই স্তূপ করে জায়গা দখল করেন। মাস্টার্স শেষ হওয়ার পরও চাকরি না হওয়ায় সিট দখল করে চাকরির প্রস্তুতি নেন এ সিনিয়ররা।
হলের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী তাহমিদুর রহমান বলেন, সাধারণত প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা রিডিংরুমে সেভাবে জায়গা পান না। অনেকে এমনভাবে বই স্তূপ করে রাখেন, যেন ওই সিটটি তারই। সবসময় তিনি ওই সিটে বসেন।
এদিকে হলের লিফট নিয়েও একাধিক শিক্ষার্থী অভিযোগ করেছেন। তারা বলেন, হলে এমনিতেই দুদিন লিফট বন্ধ থাকে। তারপর দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে বাঁধনের সামনের লিফটটি যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে প্রতি সপ্তাহে হুটহাট বন্ধ হয়ে যায়। দেখা যায়, শুধু মেরামত করার জন্যই প্রতি মাসে হলের লিফট কয়েকদিন বন্ধ থাকে।
হলের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী মাহিন আন নুর বলেন, সপ্তাহে শুক্র-শনিবার লিফট বন্ধ রাখা হয়। বাকি পাঁচদিনে প্রায়ই যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে লিফট বন্ধ থাকে। অফিসে একটি নোটিশ ফটোকপি করা আছে। প্রতিবার ওটা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। আগে পরিস্থিতি আরও খারাপ ছিল। তখন বোধহয় সপ্তাহে দুদিন লিফট চলত।
সার্বিক বিষয়ে হলের প্রাধ্যক্ষ জাকির হোসেন ভূইয়া বলেন, আমাদের অনেকগুলো সমস্যা রয়েছে ঠিকই। আমরা সবগুলোই দ্রুত সমাধানের চেষ্টা করছি।
সিট সমস্যা নিয়ে তিনি বলেন, সিট সমস্যা সব হলেই রয়েছে। অনেকে মাস্টার্স শেষ হওয়ার পরও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় হলে থাকেন। তবে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, একটা নির্দিষ্ট সেশন ধরে যারা মেয়াদোত্তীর্ণ, তাদের বের করে দেব। তখন হয়তো সিট সমস্যা কিছুটা কমে আসবে।
ক্যান্টিনে খাবারের মান নিয়ে তিনি বলেন, ক্যান্টিন আমরা সবসময় পর্যবেক্ষণের মধ্যে রাখি। তবুও মাঝেমধ্যে খারাপ খাবার দেয়। ধমক-টমক দিলে আবার ঠিক করে। খাবার ঠিক করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি ওর কাছ থেকে মুচলেকাও নিয়েছি। বের করে দেওয়ার কথাও বলেছি। তবে অন্য কেউ এখানে আসতে চায় না। তাই বাধ্য হয়েই ওকে রাখতে হচ্ছে।