বিএনপির জন্য ‘লাল কার্ড’
বিএনপির জন্য ‘লাল কার্ড’
২৪ আগস্ট ১৯৫৪। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৩৪ তম প্রেসিডেন্ট আইসেন হাওয়ার একটি ব্যতিক্রমী আইনে স্বাক্ষর করেন। ‘দ্য কমিউনিস্ট পার্টি কন্ট্রোল এ্যাক্ট’ শিরোনামে এই আইনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। মুক্ত মত প্রকাশের দেশে একটি রাজনৈতিক দলকে রাষ্ট্রীয় ভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা যায় কিনা, তা নিয়ে তীব্র বিতর্ক হয় সেসময়। কিন্তু আইনটির পক্ষে যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছিল ‘গণতন্ত্র এবং সন্ত্রাস এক সাথে চলতে পারে না। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে নির্বাচন ছাড়া সরকার পরিবর্তনের আর কোন পথ নেই।’ ১৯৫৪ সালের এই আইনটির অনেকগুলো ধারা বাতিল হয়েছে। অনেক রাজ্যই এই আইনকে বাতিল করেছে। কিন্তু এখনও আইনটি বহাল আছে। আইন অনুযায়ী বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ মুক্ত গণতান্ত্রিক দেশটিতে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্র একা নয়। বিশ্বের বহুদেশে সন্ত্রাসবাদকে লালন, সংবিধান লঙ্ঘন এবং রাষ্ট্রের জন্য বিপদজ্জনক হওয়ায় বহু রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়েছে এবং হচ্ছে। অনেক দেশেই একটি রাজনৈতিক দল প্রচন্ড জনপ্রিয় হবার পরও সন্ত্রাসবাদকে লালন করার অপরাধে সংগঠন করার অধিকার হারায়।
যুক্তরাষ্ট্রের পাশের দেশ কানাডা। ১৯৪০ সালে সে দেশে উগ্র ডানপন্থী রাজনৈতিক দল ‘ন্যাশনাল ইউনিটি পার্টিকে’ নিষিদ্ধ করা হয়। কারণ একই, উগ্রবাদ এবং সন্ত্রাসবাদকে লালন। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতে ৪০টিরও বেশী সংগঠন নিষিদ্ধ। এই নিষিদ্ধ সংগঠন গুলোর সবগুলোই সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে জড়িত। মাওইস্ট কমিউনিস্ট সেন্টার অব ইন্ডিয়া, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট অব বোরোল্যান্ড, পিপলস লিবারেশন আর্মি, পপুলার ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়া, ন্যাশনাল সোসালিস্ট কাউন্সিল অব নাগাল্যান্ডের মতো সংগঠন গুলো ভারতের অখন্ডতা এবং সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করে। এজন্য এসব সংগগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়।
ভুটান শান্তির দেশ। কিন্তু ৮০’র দশকে দেশটিতে রাজনৈতিক সন্ত্রাস ও সহিংসতা ছড়িয়ে পরে। এসময় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল ভুটান পিপলস পার্টি। জনপ্রিয় থাকার পরও দলটিকে নিষিদ্ধ করা হয়। এখনও ভুটানে পিপলস পার্টি নিষিদ্ধ। ২০০৩ সালে ভুটানে নিষিদ্ধ করা হয় কমিউনিস্ট পার্টিকেও। ঐ সংগঠনের বিরুদ্ধেও সন্ত্রাসী তৎপরতার অভিযোগ রয়েছে। কম্বোডিয়ায় ২০১৭ সালে সরকার উৎখাতে সহিংস রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করে ‘কম্বোডিয়া ন্যাশনাল রেসকিউ পার্টি।’ রাজনীতিতে সন্ত্রাসবাদকে প্রশ্রয় দেয়ার অভিযোগ সহ নানা অভিযোগে রেসকিউ পার্টিকে নিষিদ্ধ করা হয়। রাষ্ট্রের সংবিধান বিরোধী তৎপরতা এবং সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে মিশরে ২০১৪ সালে দুটি রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা হয়। এর মধ্যে একটি ‘এ্যন্টি ক্যু এলায়েন্স’ অন্যটি ‘ইনডিপেনডেন্ট পার্টি।’ মিশরে বিভিন্ন সময়ে এক ডজন রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই জার্মানীতে নাৎসী মতাদর্শের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা হয়। এখনও নাৎসীবাদের প্রতি নূন্যতম সহানুভূতির প্রমাণ পেলে, একটি রাজনৈতিক দলকে সাথে সাথে নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৯২ সালে এরকম তিনটি রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দলগুলো হলো, জার্মান অলটারনেটিভ ন্যাশনাল অফনেসিভ, ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট। একই অভিযোগে ১৯৯৫ সালে ট্রি জার্মান ওয়ার্কাস পার্টিকেও নিষিদ্ধ করা হয়।
সন্ত্রাসী তৎপরতার অভিযোগে ২০১৮ সালে হংকং ন্যাশনাল পার্টি নিষিদ্ধ করা হয়। উগ্র ডান প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির কারণে নেদারল্যান্ডে ১৯৯৮ সালে সেন্টি পার্টিকে নিষিদ্ধ করা হয়। এরকম বহু উদাহরণ আছে।
এবার বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আসা যাক। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি নিঃসন্দেহে দেশের অন্যতম জনপ্রিয় একটি রাজনৈতিক সংগঠন। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই রাজনৈতিক সংগঠনটির কার্যক্রম দেশের সংবিধান, গণতন্ত্র এবং আইন বিরোধী। বিএনপির প্রতিষ্ঠা প্রক্রিয়াটিই অবৈধ, অসাংবিধানিক এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৌলিক চেতনার পরিপন্থী। ক্যান্টনমেন্টে এই দলের সৃষ্টি। এই দলের প্রতিষ্ঠাতা সংবিধান লঙ্ঘনকারী। অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী। দেশে গণতান্ত্রিক শাসন পুনরায় চালু হবার সাথে সাথেই দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা উচিত ছিলো। কিন্তু হয়নি। ১৯৯১ এবং ২০০১ সালের দুবার এই দলটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়। তবে, ক্ষমতায় থেকেও বিএনপি সংবিধান লঙ্ঘন করেছে। সন্ত্রাসবাদকে লালন করেছে। ২০০১ সালের অক্টোবরে নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রতিপক্ষকে নির্মূল করতে সহিংসতার নৃশংস পথ বেছে নেয়। নাৎসী কায়দায় চালায় সংখ্যালঘু এবং নিরীহ জনগণের ওপর পৈশাচিক তাণ্ডব। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে বিএনপি সাংগঠনিক ভাবে জড়িত। আদালতে এটি প্রমাণিত। শুধু এই অপরাধেই দলটিকে নিষিদ্ধ করা উচিত ছিলো। অবশ্য রাষ্ট্র বিএনপিকে লাল কার্ড না দেখালেও ২০০৮ এর নির্বাচনে দেশের জনগণ ঠিকই বিএনপিকে হলুদ কার্ড দেখায়। কিন্তু এখান থেকেও বিএনপি শিক্ষা নেয়নি। ২০১৩ সালের নির্বাচনের আগে আবার বিএনপি সারাদেশে জ্বালাও পোড়াও এবং অগ্নি সন্ত্রাসের পথ বেছে নেয়। যে কারণে ১৯৫৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র আইন করে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ করেছিল। যে অপরাধে ১৯৯০ সালে ভুটানে নিষিদ্ধ হয়েছিল ভুটান পিপলস পার্টি। মিশরে ২০১৪ সালে যে অপকর্মের দায়ে ইনডিপেনডেন্ট পার্টি নিষিদ্ধ করা হয়-বিএনপিও সেই একই অপরাধ করেছিল ২০১৩ এবং ২০১৪ সালে। কিন্তু তখন বিএনপির বিরুদ্ধে রাষ্ট্র সাংবিধানিক ব্যবস্থা নিতে পারেনি। এটা সরকারের ব্যর্থতা।
অনেকেই ধারণা করেছিল ২০১৫’র তথাকথিত আন্দোলনের পর বিএনপির বোধদয় হবে। তারা অনুভব করবে যে, এদেশের জনগণ জ্বালাও পোড়াও এর সহিংস রাজনীতি পছন্দ করে না। ২০১৮’র নির্বাচনের পর বিএনপি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের পথ বেছে নেয়। ২০২২ থেকে দলটি শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ এবং নানা কর্মসূচীর মাধ্যমে সরকার বিরোধী আন্দোলন করতে থাকে। কিন্তু ২৮ অক্টোবর বিএনপি প্রমাণ করে, তারা আসলে একটি সন্ত্রাসী দল। অতীত থেকে বিএনপি শিক্ষা নেয়নি। এতটুকু বদলায় নি। ব্যালটের মাধ্যমে নয় বরং সন্ত্রাস ও অগ্নি সংযোগের মাধ্যমে তারা একটি নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চায়। পুলিশ বাহিনীর একজন সদস্যকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যার ভিডিও এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরছে। যারা পেটাচ্ছে তাদের পরিচয়ও আর গোপন নেই। এরা সবাই বিএনপির স্থানীয় পর্যায়ের নেতা। এদের নাম ঠিকানাও সবাই এখন জানে। মানুষ কত অমানবিক, পৈশাচিক হলে এভাবে সাপের মতো মানুষেকে পেটাতে পারে। এই ভিডিও দেখলে যে কারো বুক কেঁপে উঠবে। দুঃস্বপ্ন তাড়িত হবে যেকোন মানুষ। বিভৎস কায়দায় মানুষ মারার দৃশ্যের পর যদি নিহত মানুষটির অবুঝ শিশুর কান্নার দৃশ্যটি দেখেন, তাহলে আপনি আবেগ আটকে রাখতে পারবেন না। কান্নার বাঁধ ভাঙ্গা প্লাবনে আপনি সিক্ত হবেনই। কোন মানুষ এই অপরাধ সহ্য করতে পারে না। বিএনপি নেতা কর্মীরা যেভাবে রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতাল আক্রমণ করেছে, তা বিস্ময়কর। কদিন আগে ইসরায়েল গাজায় এভাবেই একটি হাসপাতাল আক্রমণ করেছিল। ঐ হামলাকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। বিশ্ব বিবেক স্তব্ধ হয়েছিল ইসরায়েলের বর্ববতায়। ঠিক একই বর্বরতা বিএনপি করেছে হাসপাতাল আক্রমণ করে। এটি জঘন্য অপরাধ। এই হামলার মাধ্যমে বিএনপি তার রাজনৈতিক অধিকার হারিয়েছে। প্রধান বিচারপতি দেশের সংবিধানের সংরক্ষক, বিচার বিভাগের প্রধান। একটি প্রতিষ্ঠান। তার বাসভবনে হামলা আসলে সংবিধানের ওপর আঘাত। সংবিধানের ওপর কোন রাজনৈতিক দল যদি আঘাত করে তাহলে সেই রাজনৈতিক দল সংবিধান লঙ্ঘনকারী, রাষ্ট্রদ্রোহী। একটি রাষ্ট্রদ্রোহী সংগঠন কোন স্বাধীন দেশে থাকতে পারে না।
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বহুমত থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিভিন্ন মতবাদকে ধারণ করবে, লালন করবে। তাদের চিন্তা, চেতনা এবং আদর্শের পক্ষে জনমত তৈরী করবে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের বক্তব্য নিয়ে জনগণের কাছে যাবে। বেশীর ভাগ জনগণ যে রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি পছন্দ করবে, নির্বাচনে তাদের ভোট দেবে। জনগণের ভোটে যারা জয়ী হবে তারা সরকার গঠন করবে। যারা সরকার গঠন করতে পারবে না, তারা সরকারের মন্দ কাজের সমালোচনা করবে। ভুল ত্রুটি ধরিয়ে দেবে। নতুন করে জনমত তৈরী করবে। এটাই গণতান্ত্রিক পদ্ধতি। যেখানে পুলিশকে সাপের মতো পিটিয়ে মারা, হাসপাতালে আগুন কিংবা নিরীহ মানুষকে কষ্ট দেয়া কোন রাজনীতি? এটা কোন রাজনীতি হবে পারে না, এটা সন্ত্রাসী তৎপরতা। এধরনের তৎপরতার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া না হলে এরা থামবে না। সন্ত্রাস আর গণতান্ত্রিক রাজনীতি পাশাপাশি চলতে পারে না। গণতন্ত্রের প্রধান শত্রু সন্ত্রাসবাদ।
২৮ অক্টোবর বিএনপি প্রমাণ করেছে, তারা একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। খেলার যেমন নিয়ম আছে। নিয়ম না মানলে লাল কার্ড দেখানো হয়। রাজনীতিরও তেমনি নিয়ম আছে। আইন ও নিয়ম না মানলে একটি রাজনৈতিক দলকেও শাস্তি পেতে হয়। বিএনপি ২০০৮ সালে হলুদ কার্ড পেয়েছে। ২৮ অক্টোবরে বিএনপির অপরাধ ভয়ংকর। এখন তাদের আর শুধু সতর্ক করার (হলুদকার্ড) সুযোগ নেই। একটি লালকার্ড তাদের অবশ্যই প্রাপ্য।
সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: [email protected]