দ্বীনের স্বার্থে শাসক হয়েও সাধারণ ছিলেন দুনিয়া বিমুখ ওমর (রা.)
দ্বীনের স্বার্থে শাসক হয়েও সাধারণ ছিলেন দুনিয়া বিমুখ ওমর (রা.)
দুনিয়াতে মূল আমল দুটি। একটি হলো আল্লাহর হক,অপরটি বান্দাহর হক।ঈমানের পর আল্লাহর হকের সাথে যদি বান্দাহর হক যথাযথভাবে আদায় করেন অবশ্যই আপনি জান্নাতের অধিকারী হবেন।তাই মৃত্যুর কয়েক মিনিট পূর্বে মহানবী (সা:) নামাজ ও অধিনস্থ কর্মচারীদের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, তোমরা আল্লাহর হক নামাজের মাধ্যমে আদায় কর। নামাজ দুনিয়াতে অপকর্ম থেকে বাঁচাবে। পরকালে জান্নাতের অধিকারি করবে।আর দ্বিতীয় কথা-তোমার অধিনস্থ কর্মচারীদের ব্যাপারে সতর্ক থাক,এটা বান্দাহর হক। আল্লাহপাক তোমাদের জন্য জান্নাত তৈরি করেছেন। তাই মহানবীও আমাদেরকে জান্নাতি কাজ করার মাধ্যমে জান্নাতের দিকে আহবান করেছেন।
রাসূলের ইন্তেকালের পর আবু ব্ক্কর (রা:) খলিফা হবেন তা মহানবী অনেক আগেই বলে গেছেন। তাই রাসূলের মৃত্যুর পরপরই আবু ব্ক্বর (রা:) কে খলিফ বানিয়ে সর্বপ্রথম বায়েত গ্রহণ করেন ওমর (রা:)। ইসলামে আবু বক্কর (রা:) এর পর ওমর (রা:) এর মর্যাদা। আবু বক্কর, ওমর, ওসমান,আলী (রা:)- এই ৪জন খোলাফায়ে রাশেদিন হিসেবে চিহ্নিত। তাদের খেলাফত ছিল ৩০ বছর।মসজিদের পাশে বায়তুল মাল প্রতিষ্ঠা করেন ওমর(রা:)। ওখান থেকে ইসলামী ব্যাংকের সূচনা।
ইসলামের ইতিহাসে ওমর (রা) ছিলেন দ্বিতীয় খলিফা। তাঁর সততা ও ন্যায়পরায়ণতা ছিল কিংবদন্তির পর্যায়ে। তিনি বিশ্বের ইতিহাসে ন্যায়পরয়ণ ও প্রজাবৎসল্য শাসক হিসাবে অমর হয়ে আছেন। তার শাসন পদ্ধতি ছিল বিজ্ঞানভিত্তিক ফলে তিনি শাসনকার্যে সফলতা অর্জন করেছিলেন।তার বিচার ব্যবস্থা ছিল নিরপেক্ষ এবং নিষ্ঠুর। আইনের চোখে উচু-নিচু,ধনী-নির্ধন,আপন-পর কোন ভেদাভেদ ছিল না।মদ্যপানের অপরাধে স্বীয় পুত্র আবু শাহমাকে তিনি কঠোর শাস্তি দিয়েছিলেন।বিচার বিভাগের সংস্কার সাধন ইসলামের ইতিহাসে তিনি একটি অবিস্বরনীয় কীর্তি।তিনিই সর্বপ্রথম বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগের আওতামুক্ত করে একটি আলাদা বিভাগ হিসাবে চালু করেন। তিনি ছিলেন গণতন্ত্রমনা ।
রাষ্ট্রের যাবতীয় গুরুত্বপূর্ন কাজ তিনি সাহাবিদের সঙ্গে পরামর্শ করে সম্পাদন করতেন।তিনি শাসন ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করার জন্য মজলিশে শূরা বা উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেন। তিনি নিজে অন্ধকার রাতে একাকী বেরিয়ে পড়তেন এবং প্রজাদের ঘরে ঘরে গিয়ে তাদের সুখ-দুঃখের খোঁজ খবর নিতেন। ক্ষুধার্ত শিশুদের কান্নার আওয়াজ শুনে তিনি নিজের কাঁধে আটার বস্তা বহন করে নিয়ে যান তাদের তাঁবুতে। স্বীয় সহধর্মিনী উম্মে কুলসুমকে নিয়ে যান এক বেদুইনের ঘরে,তার প্রসব বেদনায় কাতর স্ত্রীকে সাহায্য করার জন্য। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না।
একদিন প্রচন্ড গরমে ওমর (রা:) বের হলে পথে ওসমান (রা:) এর সাথে দেখা হলো।ওসমান(রা:)জিজ্ঞেস করলেন প্রচন্ড গরমে তিনি কেন বাইরে। ওমর (রা:) বায়তুল মালের একটা সদকার উট হারিয়ে গেছে,সেটির সন্ধানে বের হয়েছেন জানান। ওসমান(রা:)বললেন, আপনি চাইলে আরেকজনকে পাঠাতে পারতেন।তিনি বললেন, কেয়ামতের ময়দানে আমার দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করবে না।আমাকে জিজ্ঞেস করবে আল্লাহ, আমি কি জবাব দেব? তাহলে গরম কমলে বের হতেন এমন প্রশ্নে বলেন,দেরি করলে উটটি দূরে চলে যেতে পারে। কেয়ামতের ময়দানে জবাবদিহি করতে হবে আমাকে ।
একজুমায় ওমর (রা:) খুতবা দিচ্ছেন।উপস্থিত মুসল্লিদের বললেন, আমার কথা শোন। তখন একজন সাহাবী দাঁড়িয়ে বললেন,ওমর আপনার কথা আমরা শুনবো না, অনুসরণ করবো না।কেন? তার কারন হলো-গণিমতের মাল আপনি ভক্ষণ করেছেন।প্রত্যেককে একটি করে চাদর দিয়েছেন আপনি খুতবা দেয়ার সময় দেখলাম আপনার শরীরে দুটি চাদর।একটি গায়ে আরেকটি লুঙ্গি হিসেবে ব্যবহার করেছেন।এই প্রশ্নের জাবাবে সন্তুষ্ট হলে আপনার কথা শুনবো। তখন ওমর (রা:)ছেলে আবদুল্লাহকে বললেন আবদুল্লাহ দাঁড়াও।এই প্রশ্নের জবাব তুমি দাও।আবদুল্লাহ বললেন, আমার পিতার অতিরিক্ত কাপড় নেই।তাঁর একটি কাপড় শুকাতে দেয়ায় আমার চাদরটি তিনি পরেছেন,তাই দুটি হেয়ে গেছে। তখন ওই ব্যাক্তি বললেন, আমাদের সন্দেহ দূর হয়ে গেছে।তাঁরা এভাবে মুসলমানের আমানত, ঈমান, রাসূলের পদ্ধতি হেফাজত করেছেন। তারা ছিলেন দুনিয়া বিমুখ শাসক।
একবার কিছু সুগন্ধি দ্রব্য বাহরাইন থেকে ওমর (রা.) নিকট পাঠানো হলো। তিনি সবাইকে লক্ষ্য করে বললেন, তোমাদের মধ্যে এমন কেউ আছ কি, যে এ সুগন্ধি দ্রব্য মেপে সমান ভাগ করে মুসলমানের মধ্যে বণ্টন করতে পার? ওমর (রা.) স্ত্রী আতেকা বললেন, আমি পারব। ওমর (রা.) বললেন, আতেকা ছাড়া আর কেউ আছে কি? আতেকা বললেন, আমিরুল মোমিনিন, আমি মেপে দিলে অসুবিধা কী? ওমর (রা.) বললেন, আমার আশঙ্কা হয়, মাপার সময় তুমি জিনিসটা হাত দিয়ে ধরবে এবং তোমার হাত সুবাসিত হয়ে যাবে। এরপর সেই সুবাসিত হাত তুমি মুখে মেখে নেবে এবং সুগন্ধি উপভোগ করবে। অন্যদের চেয়ে এতটুকু বাড়তি সুবিধা তুমি পেয়ে যাও, তা আমি পছন্দ করি না।
ওমর (রা.) গভীর রাতে ছদ্মবেশে একদিন মদিনার প্রজাদের খোঁজখবর নিচ্ছিলেন। এ সময় দেখতে পেলেন এক রাখাল এক পাল ছাগল নিয়ে যাচ্ছে। তিনি রাখালকে পরীক্ষা করার জন্য বললেন, এ ছাগলগুলোর মধ্যে যে কোনো একটি ছাগল আমার কাছে বিক্রি করে দাও। রাখাল বলল, এ ছাগলগুলো আমার নয়, আমার মনিবের। ওমর (রা.) বললেন, মনিব তো দেখতে পাবে না। একটা ছাগল বেঁচে দাও। আর মনিবকে বলে দিও যে, একটি ছাগল বাঘে খেয়ে ফেলেছে। রাখাল রেগে চিৎকার করে বলে উঠল, আল্লাহ কি দেখতে পান না? তার কথায় ওমর (রা.) চুপ করে রইলেন। রাখাল রাগে গরগর করতে করতে ছাগল নিয়ে চলে গেল। পরদিন সকালে ওমর (রা.) ওই রাখালের মনিবের কাছে গেলেন এবং তাকে কিনে নিয়ে স্বাধীন করে দিলেন। বললেন, হে যুবক! কাল তুমি আল্লাহ সম্পর্কে যে কথাটি বলেছিলে তা আজ তোমার দুনিয়ার গোলামি চুকিয়ে দিল। আমি আশা করি তোমার এ খোদাভীতি কেয়ামতের দিন দোজখের আজাব থেকেও মুক্তি দেবে।
একদিন হযরত ওমর (রা.) এক বেদুইনের কাছ থেকে ঘোড়া কিনলেন। ঘোড়ার দাম পরিশোধ করেই তিনি ঘোড়ায় চড়লেন। কিছু দূর যেতেই ঘোড়াটি হোঁচট খেয়ে খোঁড়া হয়ে গেল। ওমর (রা.) ভাবলেন ঘোড়াটির আগে থেকেই পায়ে কোনো খুঁত ছিল, যা সামান্য ধাক্কা খেয়ে ভেঙে গেছে। তিনি ঘোড়ার মালিককে বললেন, তোমার ঘোড়া ফেরত নাও। এর পা ভাঙা। সে বলল- আমিরুল মোমিনিন! আমি ফেরত নিতে পারব না। কারণ আমি যখন বিক্রি করেছি, তখন ঘোড়াটি ভালো ছিল। ওমর (রা.) বললেন, ঠিক আছে। একজন সালিশ মানা হোক। সে আমাদের বিরোধ মিটিয়ে দেবে। লোকটি বলল, শুরাইহ বিন হারিস কান্দি নামে একজন ভালো জ্ঞানী লোককে আমি চিনি। তাঁকেই সালিশ মানা হোক। ওমর (রা.) রাজি হলেন। উভয়ে সালিশের জন্য গেলে শুরাইহ খলিফাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমিরুল মোমিনিন! আপনি কি ঘোড়াটি সুস্থ অবস্থায় কিনেছিলেন? ওমর (রা.) বললেন, হ্যাঁ। শুরাইহ বললেন, তাহলে ঘোড়াটি ফেরত দিতে হলে যে অবস্থায় কিনেছিলেন সে অবস্থায় ফেরত দিন। এ কথা শুনে ওমর (রা.) চমৎকৃত হয়ে বললেন, তুমি নির্ভুল ও ন্যায্য রায় দিয়েছ। তুমি কুফা চলে যাও। আজ থেকে তুমি কুফার বিচারপতি। সেই থেকে দীর্ঘ ৬০ বছর তিনি বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেন। হযরত আলীর (রা.) সময়ে তিনি খলিফার বিরুদ্ধে অনুরূপ আর একটি রায় দিয়ে প্রধান বিচারপতি পদে উন্নীত হন। তারপর উমাইয়া শাসনকালে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের স্বেচ্ছাচারিতায় বিরক্ত হয়ে তিনি পদত্যাগ না করা পর্যন্ত কোনো শাসকই তাঁকে পদচ্যুত করার সাহস পাননি।
একবার রোমের সম্রাট ওমরের কাছে একজন দূত পাঠালেন। তাঁর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার জন্য ও কাজকর্ম স্বচক্ষে দেখার জন্য। দূত মদীনায় প্রবেশ করে ওমর(রা:)পেল না। লোকজনকে সে জিজ্ঞাসা করল যে,‘‘তোমাদের বাদশাহ কোথায়?’’লোকেরা বলল ‘‘আমাদের কোনো বাদশাহ নেই।বরং একজন আমীর আছেন যিনি মদীনার বাইরে গেছেন।”
দূত তাঁর খোঁজে মদীনার বাইরে গেল। খুঁজতে খুঁজতে সে তাঁকে পেল এক গাছের তলায়, মরুভূমির বালুরাশির উপর নিজের হাতের ছোট লঠিটি মাথার নিচে রেখে গুমিয়ে আছেন। যে লাঠি দিয়ে তিনি কোনো অন্যায় কাজ হতে দেখলে তা বন্ধ করতেন। উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে এ অবস্থায় দেখে তার অন্তরে সম্ভ্রম সৃষ্টি হলো। সে মনে মনে ভাবল: তিনি এমন একজন লোক যাঁর ভয়ে সমস্ত রাজা-বাদশাহরা সন্ত্রস্ত, ভীত। অথচ তিনি নির্ভাবনায় একাকী ঘুমিয়ে আছেন। তিনি ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তাই এমন স্বস্তিতে ঘুমাচ্ছেন। আর আমাদের রাজা-বাদশাহরা অত্যাচার-অবিচারে লিপ্ত।যার ফলে তারা সবসময় ভয়ে ভয়ে দিনযাপন করে। বিনিদ্র রাত কাটায়।
ওমর (রা.) এর নির্দেশ ছিল:অপরাধ যেমন শাস্তিও তেমন।সে তোমাকে যেভাবে প্রহার করেছে,তুমিও সেভাবে ঠিক ততখানি প্রহার কর। বিচারকাজে রাজা-প্রজা দেখার সুযোগ নেই। প্রজারা শাসকের দাস নয়। শাসকরা প্রজাদের সেবক। প্রজারা ঠিক তেমনি স্বাধীন যেমন তাদের মায়ের পেট থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় স্বাধীন।