আন্তর্জাতিক

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিমুখী আচরণে বিশ্বজুড়ে ক্ষোভ

গাজায় মানবিক যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ভোটাভুটিতে আবারও ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ উপত্যকায় দুই মাসের সময় ধরে ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় ১৭ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। যাদের অর্ধেকের বেশি নারী ও শিশু। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন গাজায় ইসরায়েল গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ করছে বলে অভিযোগ করেছে। ইসরায়েলি হামলা বন্ধে এই যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব আনা হয়েছিল। সেই প্রস্তাবে শুক্রবার ভেটো দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। অথচ একই দিনে বিশ্বের ১৩টি দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে ৩৭ ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে মার্কিন প্রশাসন। মানবাধিকার ইস্যুতে দেশটির এমন দ্বিমুখী অবস্থানের সমালোচনা সরব হয়েছে জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গোষ্ঠী ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ।

কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা খবরে বলা হয়েছে, শুক্রবার যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্যের মধ্যে ১৩ সদস্য পক্ষে ভোট দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দিয়েছে আর যুক্তরাজ্য ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোর কারণেই কোনও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি নিরাপত্তা পরিষদ।

ফিলিস্তিন
ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শাতায়েহ বলেন, এটি অপমানজনক এবং যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে ভেটো দিয়ে ইসরায়েলকে গণহত্যা, ধ্বংস ও বাস্তুচ্যুত করার জন্য আরেকবার অনুমতি দিলো যুক্তরাষ্ট্র।

ফিলিস্তিনের জাতিসংঘের দূত রিয়াদ মনসুর বলেন, ভোটের ফলাফলে বিপর্যয় নেমে এসেছে। আপনি যদি ফিলিস্তিনি জনগণকে সমর্থন করেন তবে আপনাকে অবশ্যই এই যুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে, লাখো ফিলিস্তিনির জীবন ঝুলে আছে।

হামাস
মার্কিন ভেটোর তীব্র নিন্দা জানিয়ে ওয়াশিংটনের পদক্ষেপকে অনৈতিক এবং অমানবিক বলছে সশস্ত্র ফিলিস্তিনি প্রতিরোধী গোষ্ঠী হামাস। হামাস বলেছে, ভেটো দেওয়ার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের মানুষের হত্যা, গণহত্যা চালানো এবং জাতিগত নির্মূল করার প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি অংশ নিলো।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল
যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মহাসচিব অ্যাগনেস ক্যালামার্ড বলেছেন, এই ভেটো দেওয়ার মাধ্যমে, যুক্তরাষ্ট্র গাজায় মৃত্যু, ব্যাপক ধ্বংস এবং মানবিক বিপর্যয়ের মুখে বেসামরিক দুর্ভোগের প্রতি নির্মম অবহেলা দেখিয়েছে।

ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস
ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস (এমএসএফ) বলেছে, নিরাপত্তা পরিষদও চলমান হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। যুক্তরাষ্ট্র একা ভেটো দিয়েছে। গাজার হত্যাকাণ্ডের কথা উল্লেখ করে সংস্থাটি বলেছে, মানুষের জীবন তাদের কাছে কম গুরুত্বপূর্ণ।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সাবেক নির্বাহী পরিচালক কেনেথ রথ বলছেন, মার্কিন সরকার যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র আত্মরক্ষার জন্য ইসরায়েলের অধিকারকে প্রাধান্য দিচ্ছে। তিনি বলেন, বাইডেন কী মনে করেন? এর মাধ্যমে কি হামাস আরও ক্ষিপ্ত হচ্ছে না?

সংস্থাটি বলেছে, অস্ত্র সরবরাহ ও কূটনৈতিক সমর্থন অব্যাহত রেখে গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

ইরান
মার্কিন ভেটোর পর ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ান মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি নিয়ে সতর্ক করে এএফপিকে বলেছেন, যতদিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে সমর্থন করবে ততদিন যুদ্ধ অব্যাহত থাকবে এবং ওই অঞ্চলে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বজায় থাকবে।

চীন
জাতিসংঘের চীনা স্থায়ী প্রতিনিধি ঝাং জুন বলেছেন, গাজার মানুষের জীবন ও নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে যুদ্ধবিরতি প্রত্যাখান করা আত্ম-প্রতারণামূলক। নারী ও শিশু ও মানবাধিকার সুরক্ষার কথা উল্লেখ করে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়াকে প্রত্যাখ্যান করা ভণ্ডামি।

রাশিয়া
জাতিসংঘে রাষ্ট্রদূত দিমিত্রি পোলিয়ানস্কি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কারণেই আমাদের চোখের সামনে কয়েক হাজার ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েল বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের নিষ্ক্রিয়তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেছে রাশিয়া

ফ্রান্স
জাতিসংঘের রাষ্ট্রদূত নিকোলাস ডি রিভিয়ের বলছেন, গাজার সংকট আরও তীব্র হচ্ছে কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদে ঐক্যের অভাবে বারবার কোনও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়নি।

তুরস্ক
তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান বলেছেন, ভেটো দেওয়ার পর গাজা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র এখন একাই রয়ে গেছে। তিনি বলেন, গাজা ইস্যুতে ইসরায়েলের কাছে অসহায় যুক্তরাষ্ট্র।

গ্রিসের সাবেক অর্থমন্ত্রী ইয়ানিস ভারোফাকিস, নিউজিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হেলেন ক্লার্ক, নিউইয়র্কে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাই কমিশনারের সাবেক প্রধান ক্রেগ মোখিবার, মার্কিন এই সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন।

যা বলছে ইসরায়েল, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র

ইসরায়েল
ইসরায়েলের জাতিসংঘের রাষ্ট্রদূত গিলাদ এরদান ভোটের পরে নিরাপত্তা পরিষদে ভাষণ না দিলেও এক বিবৃতিতে বলেন, সব জিম্মিদের ফিরিয়ে আনা এবং হামাসের ধ্বংসের মাধ্যমেই যুদ্ধবিরতি সম্ভব হবে। ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এলি কোহেন বলেছেন, যুদ্ধবিরতি দিলে হামাস সন্ত্রাসী সংগঠনকে ধ্বংস করা যাবে না।

যুক্তরাষ্ট্র
মার্কিন দূত রবার্ট উড বলছেন, যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের খসড়া তৈরি ও ভোটাভুটির প্রক্রিয়াটি খুব দ্রুত করা হয়েছে এবং এতে উপযুক্ত পরামর্শেরও অভাব ছিল। তিনি বলেন, ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের ওপর হামাসের আকস্মিক হামলার কথাই খসড়ায় আনা হয়নি।

যুক্তরাজ্য
জাতিসংঘে ব্রিটেনের রাষ্ট্রদূত বারবারা উডওয়ার্ড বলেছেন, প্রস্তাবে হামাসের কোনও মন্তব্য না থাকায় তার দেশ ভোটদানে বিরত ছিল। তিনি বলেন, ইসরায়েলকে হামাসের দ্বারা সৃষ্ট হুমকি মোকাবিলা করতে সক্ষম হতে হবে এবং আন্তর্জাতিক মানবিক আইন মেনে চলতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d