ধর্ম

লূত আ.-এর জাতি যে পাপের কারণে ধ্বংস হয়েছিল

হজরত লূত আলাইহিস সালাম ছিলেন হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের ভাতিজা। তিনি জন্মভূমি ‘বাবেল’ শহর থেকে হিজরত করে বায়তুল মুক্বাদ্দাসের অদূরে কেনআনে চলে আসেন। আল্লাহ লূত আলাইহিস সালামকে নবুয়ত দান করেন এবং কেনআন থেকে অল্প দূরে জর্ডান ও বায়তুল মুক্বাদ্দাসের মধ্যবর্তী ‘সাদূম’ অঞ্চলের অধিবাসীদের পথ প্রদর্শনের জন্য প্রেরণ করেন।

এখানকার ভূমি ছিল উর্বর ও শস্য-শ্যামল। এখানে সবধরনের শস্য ও ফলের প্রাচুর্য ছিল। এসব ঐতিহাসিক তথ্য বিভিন্ন তাফসীর গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে।

হজরত লূত আলাইহিস সালামের জাতি আল্লাহর ইবাদত ছেড়ে শিরক ও কুফরীতে লিপ্ত হয়েছিল। দুনিয়াবী উন্নতির চরম শিখরে উন্নীত হওয়ার কারণে তারা সীমা লঙ্ঘনকারী জাতিতে পরিণত হয়েছিল। ইতিপূর্বের ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিগুলির মতো তারা চূড়ান্ত ভোগ বিলাসে গা ভাসিয়ে দিয়েছিল।

অন্যায়-অনাচার ও নানাবিধ দুষ্কর্ম তাদের মজ্জাগত অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। এমনকি পুংমৈথুন বা সমকামিতার মত নোংরামিতে তারা লিপ্ত হয়েছিল, যা তাদের আগে কোনো জাতির মাঝে দেখা যায়নি। এই কুকাজকে আরবীতে ‘লূত্বিয়্যাহ’ এবং উর্দুতে ‘লেওয়াত্বাত’ বলা হয়।

জন্তু-জানোয়ারের থেকেও নিকৃষ্ট ও হঠকারী এই জাতির হেদায়াতের জন্য আল্লাহ লূত আলাইহিস সালামকে প্রেরণ করলেন।

হজরত লূত আলাইহি সালাম তাদেরকে আল্লাহর পথে আহ্বান করলেন এবং সব ধরনের পাপ ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু তারা আহ্বানে সাড়া দিলো না। নিজেদের খেয়াল-খুশিমতো পাপাচারে লিপ্ত থাকলো। নবীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতে লাগলো। তৎকালীন সময়ে কঠিন পরিস্থিতি পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা তুলে ধরেছেন এভাবে-

হজরত লূত আলাইহি সালাম প্রথমে তাদেরকে আল্লাহর একত্ববাদের ওপর দাওয়াত দিয়ে বললেন,

إِنِّيْ لَكُمْ رَسُوْلٌ أَمِيْنٌ، فَاتَّقُوا اللَّهَ وَأَطِيْعُوْنِ، وَمَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ مِنْ أَجْرٍ إِنْ أَجْرِيَ إِلاَّ عَلَى رَبِّ الْعَالَمِيْنَ،

‘আমি তোমাদের জন্য বিশ্বস্ত রাসূল। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর। আমি এর জন্য তোমাদের নিকটে কোনরূপ প্রতিদান চাই না। আমার প্রতিদান তো বিশ্বপ্রভু আল্লাহ দিবেন’ (সূরা শুআরা, (২৬), আয়াত, ১৬২-১৬৫)।

লূত আলাইহি সালাম তার জাতিকে আল্লাহকে ভয়ের কথা বলার পর তাদের বদভ্যাসের প্রতি ইঙ্গিত করে বললেন,

أَتَأْتُوْنَ الذُّكْرَانَ مِنَ الْعَالَمِيْنَ

‘বিশ্ববাসীর মধ্যে কেন তোমরাই কেবল পুরুষদের নিকটে (কুকর্মের উদ্দেশ্যে) এসে থাক’? (সূরা আরাফ, (৭), আয়াত, ৮১)

মহান আল্লাহ শরয়ী বিবাহ-বন্ধন দ্বারা নারীদের সঙ্গে জৈবিক চাহিদা পূরণ করা হালাল করেছেন, এর বিপরীতে পুরুষের সঙ্গে জৈবিক চাহিদা পূরণ করা হারাম। কিন্তু লূত আলাইহি সালামের সম্প্রদায় স্ত্রীদের পরিবর্তে পুরুষদের সঙ্গে জৈবিক চাহিদা পূরণ করতে শুরু করেছিল। পৃথিবীতে এই পাপাচারের সূত্রপাত তাদের মাধ্যমেই হয়। লূত আলাইহি সালাম তাদের এই পাপাচার থেকে সরে আসতে বললেন। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে,

وَ تَذَرُوۡنَ مَا خَلَقَ لَکُمۡ رَبُّکُمۡ مِّنۡ اَزۡوَاجِکُمۡ ؕ بَلۡ اَنۡتُمۡ قَوۡمٌ عٰدُوۡنَ

‘আর তোমাদের স্ত্রীগণকে বর্জন কর, যাদেরকে তোমাদের জন্য তোমাদের পালনকর্তা সৃষ্টি করেছেন? নিঃসন্দেহে তোমরা সীমা লঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়’ (সূরা শুআরা, (২৬), আয়াত, ১৬৬)।

জবাবে তার সম্প্রদায়ের নেতারা বলল,

لَئِن لَّمْ تَنتَهِ يَا لُوْطُ لَتَكُوْنَنَّ مِنَ الْمُخْرَجِيْنَ، قَالَ إِنِّيْ لِعَمَلِكُم مِّنَ الْقَالِيْنَ

‘হে লূত! যদি তুমি (এসব কথাবার্তা থেকে) বিরত না হও, তাহ’লে তুমি অবশ্যই বহিষ্কৃত হবে’। তিনি বললেন, ‘আমি তোমাদের এইসব কাজকে ঘৃণা করি’ (সূরা শুআরা, (২৬), আয়াত, ১৬৭-১৬৮)।

সমকামীতার পাপ ছাড়াও এই সম্প্রদায় আরও বেশ কয়েকটি গুরুত্বর অপরাধে জড়িত ছিল। সেই পাপাচারগুলো হলো- আল্লাহর সাথে কুফরি এবং রাসূলদের প্রতি মিথ্যারোপ। এর পাশাপাশি রাহাজানি, অর্থাৎ পথে মানুষদেরকে আক্রমন করে তাদের হত্যা করত এবং সবকিছু নিয়ে নিত।

এসবের সঙ্গে তারা আরেকটি পাপাচারে লিপ্ত ছিল। তাহলো- মজলিসে সবার সামনে এমন অপকর্ম করত, যা সম্পূর্ণ অশোভনীয় ছিল। তাদের একজন অন্যজনকে তা থেকে বাধা দিত না। কোরআনে তাদের তৃতীয় পাপকাজটি নির্দিষ্ট করেনি। এ থেকে জানা যায় যে, যে কোন গুনাহ প্রকাশ্যে করাও একটি স্বতন্ত্র গোনাহ।

লূত আলাইহিস সালাম তাদের তিনটি প্রধান নোংরামির কথা উল্লেখ করে বলেন,

وَلُوْطاً إِذْ قَالَ لِقَوْمِهِ إِنَّكُمْ لَتَأْتُوْنَ الْفَاحِشَةَ مَا سَبَقَكُمْ بِهَا مِنْ أَحَدٍ مِّنَ الْعَالَمِينَ، أَئِنَّكُمْ لَتَأْتُوْنَ الرِّجَالَ وَتَقْطَعُوْنَ السَّبِيْلَ وَتَأْتُوْنَ فِيْ نَادِيْكُمُ الْمُنْكَرَ فَمَا كَانَ جَوَابَ قَوْمِهِ إِلاَّ أَنْ قَالُوا ائْتِنَا بِعَذَابِ اللَّهِ إِنْ كُنْتَ مِنَ الصَّادِقِيْنَ، قَالَ رَبِّ انْصُرْنِي عَلَى الْقَوْمِ الْمُفْسِدِيْنَ

‘তোমরা এমন অশ্লীল কাজ করছ, যা তোমাদের পূর্বে পৃথিবীর কেউ কখনো করেনি’। ‘তোমরা কি পুংমৈথুনে লিপ্ত আছ, রাহাজানি করছ এবং নিজেদের মজলিসে প্রকাশ্যে গর্হিত কর্ম করছ’? জবাবে তার সম্প্রদায় কেবল একথা বলল যে, আমাদের উপরে আল্লাহর গজব নিয়ে এসো, যদি তুমি সত্যবাদী হও’। তিনি তখন বললেন, ‘হে আমার পালনকর্তা! এই দুষ্কৃতিকারী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে তুমি আমাকে সাহায্য কর।’ ( সূরা আনকাবূত, (২৯), আয়াত, ২৯)।

তাদের এমন হঠকারিতা ও অবাধ্যতার পর লূত আলাইহিস সালাম আল্লাহ তায়ালা কাছে আল্লাহর সাহায্য কামনা করলেন। ফলে যথারীতি গজব নেমে এলো তাদের ওপর। একদিন ভোর বেলা তাদের শক্তিশালী ভূমিকম্প দিয়ে ধ্বংস করে দেন আল্লাহ তায়ালা। ভূমিকম্প এতো শক্তিশালী ছিল যে তাদের পুরো নগরটি সম্পূর্ণ উল্টে যায়।

মুফাসসিরগণ বলেন, লূত আলাইহিস সালামের সম্প্রদায়কে হজরত জিবরাইল আলাইহিস সালাম নিজের ডানা দিয়ে হালকা আঘাত করেন। এতেই সকল পাপাচারী অন্ধ হয়ে যায়।

এরপর ডানা দিয়ে পুরো সাদ্দূম নগরীকেই গোড়াসহ তুলে ফেলেন, এত উঁচুতে নিয়ে যান যে প্রথম আসমানের রক্ষী ফেরেশতারাও সাদ্দূম নগরীর কুকুর আর মোরগের ডাক শুনতে পেয়েছিলেন। ঘুমন্ত মানুষের ওপর তাদের ঘরবাড়ি আছড়ে পড়ে। পাশাপাশি আকাশ থেকে বৃষ্টির মতো কঙ্কর নিক্ষিপ্ত হতে থাকে।

এবার পুরো জনপদকে উল্টো করে সজোরে জমিনে ধ্বসিয়ে দেওয়া হয়। এবার আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রত্যেক পাপীর নাম লেখা পাথর বর্ষণ করা হয়। এরপর আল্লাহ সে স্থানে দূষিত পানির জলাধারা প্রবাহিত করে দেন।

কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘অবশেষে আমার (আল্লাহর) আদেশ চলে আসলো, তখন আমি উক্ত জনপদকে ধ্বংস করে দিলাম এবং তাদের উপর স্তরে স্তরে পাথর বর্ষণ করলাম।’ (সূরা হুদ, আয়াত, ৮২)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d