চট্টগ্রামপার্বত্য চট্টগ্রাম

রাঙ্গামাটিতে ছোট মাছে বড় রাজস্ব

রাঙামাটি পার্বত্য জেলাকে ঘিরে রাখা দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ কৃত্রিম হ্রদ কাপ্তাই যেন প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। কাপ্তাই হ্রদের সৌন্দর্যের পাশাপাশি এই হ্রদে রয়েছে প্রচুর মাছ। এই হ্রদেই পাওয়া যায় পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ কাচকি, চাপিলা, মলা, ঢেলাসহ বিভিন্ন ছোট মাছ।

তবে বিভিন্ন ছোট মাছের মধ্যে কাচকি ও চাপিলা এই দুই মাছের বেশ চাহিদা রয়েছে রাঙামাটিসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। আর কাপ্তাই হ্রদে থেকে প্রায় ৮০ শতাংশই কাচকি ও চাপিলা মাছ আহরণ হয়। এছাড়া সরকার প্রতিবছর কাপ্তাই হ্রদের মাছ থেকে যে শুল্ক আদায় করে, তার ৯৫ শতাংশই আসে এই দুই মাছ থেকে। আকারে ছোট হলেও অর্থনীতিতে এই দুই মাছ বড় ধরনের আয় এনে দিচ্ছে। তাই ছোট প্রজাতির এই দুই মাছ ভূমিকা রাখছে দেশের অর্থনীতিতে।

কাপ্তাই হ্রদে মাছ শিকারের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে প্রায় ২৫ হাজার জেলে। ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের জালের মাধ্যমে হ্রদ থেকে মাছ আহরণ করা হয়। তবে যেকোনো জালেই সবচেয়ে বেশি যে দুটি মাছ আহরিত হয় তা হলো কাচকি ও চাপিলা। এই মাছগুলো আকারে ছোট হলেও স্বাদে অনন্য। পার্বত্য চট্টগ্রাম কিংবা চট্টগ্রাম মহানগর তো বটেই ঢাকাসহ বিভিন্নস্থানে বেশ কদর এই মাছ দুটির। প্রতিদিন রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদ থেকে কাচকি-চাপিলা সারাদেশে যাচ্ছে পাইকারদের মাধ্যমে। এই দুই ছোট আকারের মাছের ওপরই নির্ভর এখানকার ব্যবসায়ী, জেলেসহ সংশ্লিষ্ট সকলেই।

বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনের রাঙামাটি মৎস্য অবতরণ ঘাটে প্রতিদিন যে পরিমাণ মাছ অবতরণ হয় তার ৯৫ শতাংশই এই দুই মাছ। এজন্য কাপ্তাই হ্রদকে কাচকি-চাপিলার ভান্ডার বলা হয়। ১৯৬৫-৬৬ সালে কাপ্তাই হ্রদ থেকে কাচকি ও চাপিলা আহরণ ৩% থেকে বিগত ছয় দশকে বেড়ে বর্তমানে প্রায় ৯৫ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছেছে। বিএফডিসির ঘাটে কাচকি, চাপিলার সারি সারি ড্রামই বলে দেয় হ্রদে কাচকি ও চাপিলার উৎপাদন কতটা বেশি।

মৎস্য ব্যবসায়ী শাহেদ বলেন, আমি আমার ব্যবসায়ী জীবনের শুরু থেকেই দেখে আসছি কাপ্তাই হ্রদ থেকে আহরিত মাছের ৯০ শতাংশই ছোট মাছ। আর ছোট মাছের মধ্যে কাচকি ও চাপিলা মাছগুলোই বেশি আসে। আর এই মাছগুলো আমরা বেশিরভাগই ঢাকা বা অন্যান্য জেলাগুলোতে বিক্রি করে থাকি।

আরেক ব্যবসায়ী নাজিম উদ্দিন বলেন, আমাদের ফিসারিতে যা মাছ আসে তার ৯০ ভাগই হলো ছোট মাছ, ১০ ভাগ বড় মাছ। ছোট মাছ বলতে লেকে সাধারণত কাচকি ও চাপিলা এই দুটোই বেশি আছে।

রাঙামাটি মৎস্য ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি উদয়ন বড়ুয়া বলেন, রাঙামাটি বিএফডিসি কর্তৃক যে কার্পজাতীয় পোনা মাছগুলো কাপ্তাই হ্রদে ছাড়া হয় তার অধিকাংশই স্থানীয় চাহিদা মেটাতে চলে যায়। কিন্তু কাচকি ও চাপিলার মতো যে মাছগুলো প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হয় এগুলো দিয়েই আমাদের জেলেরা ও ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করে। যেহেতু এই মাছগুলোর চাহিদা সারা দেশজুড়েই আছে তাই বলা যায় মৎস্য সংশ্লিষ্ট রাজস্ব তৈরিতে এই দুই মাছের ভূমিকা বেশি।

তিনি আরও বলেন, রাঙামাটিতে নিবন্ধিত জেলে আছে প্রায় ২৫ হাজার। পাশাপাশি শ্রমিক, মৎস্য পরিবহন শ্রমিকসহ প্রায় ৪০ হাজারের মতো মানুষ মৎস্য সংশ্লিষ্ট কাজে জড়িত। তাদের পুরো জীবন টাই কাচকি ও চাপিলার ওপর নির্ভরশীল।

কাপ্তাই হ্রদ বৃহত্তম মৎস্য ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি কবির আহম্মদ বলেন, ৩ মাসের বেশি মাছ আহরণ বন্ধ থাকার পর প্রায় ৬ মাস যাবৎ মাছ আহরণ চলছে। শীত মৌসুম থাকার কারণে কাচকি চাপিলাসহ বিভিন্ন মাছ একটু কম আহরণ হয়েছিল, সামনের মাস থেকে গরম বাড়লে মাছ আহরণও বাড়বে। তবে কাপ্তাই হ্রদে যেকোনো প্রজাতির মাছের পরিমাণ বাড়াতে হলে কাপ্তাই হ্রদ খননের বিকল্প নেই। হ্রদ খননের জন্য অতিসত্ত্বর কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি।

কাপ্তাই হ্রদে বংশবৃদ্ধির জন্য বড় প্রজাতির মাছের পোনা ছাড়তে হলেও কাচকি মাছের বংশ বৃদ্ধি ঘটে প্রাকৃতিকভাবে। আলাদা ভাবে
পোনা ছাড়তে হয় না। তাছাড়া প্রজনন ক্ষমতা বেশি হওয়ায় সারাবছরই মাছ উৎপাদন ভালো।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের রাঙামাটি নদী উপকেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা লিপন মিয়া বলেন, কাপ্তাই লেকে যে পানির গুণাগুণ সেটি মাছ চাষ ও মাছের বৃদ্ধির জন্য খুবই উপযোগী। পাশাপাশি হ্রদে প্রাকৃতিক খাদ্যের প্রাচুর্যতাও বেশি। কাচকি মাছ সাধারণত সারাবছরই ডিম দিয়ে থাকে, তবে এদের যে ব্রিডিং পিরিয়ড সেটি জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত, যা খুব লম্বা একটি সময়। এরা ৩-৪ মাস বয়সেই প্রজননের জন্য উপযোগী হয়ে যায়। আর আমাদের যে অন্যান্য দেশীয় ছোট মাছগুলো রয়েছে তা কাচকি মাছের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারে না। তাই কাপ্তাই হ্রদে কাচকি ও চাপিলা মাছের বৃদ্ধির পরিমাণ বেশি।

পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ এই মাছ বড় আয় এনে দিচ্ছে বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনকে (বিএফডিসি)। গত বছর এই দুই মাছ থেকে সরকার রাজস্ব পেয়েছে প্রায় ১১ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএফডিসি) রাঙামাটি অঞ্চলের ব্যবস্থাপক কমান্ডার আশরাফুল আলম ভূঁইয়া বলেন, আমরা যদি পুষ্টি বিবেচনা করি তাহলে বড় মাছের তুলনায় ছোট মাছের নিউট্রিশন ভ্যালু অনেক বেশি। কাচকি মাছে ভিটামিন, প্রোটিন ও মিনারেলের পরিমাণ অন্যান্য মাছের তুলনায় বেশি। সেটি বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে। এই ছোট মাছগুলো সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকাতে প্রান্তিক জনগণের পুষ্টির চাহিদা মেটাচ্ছে এই মাছগুলো। এদের প্রজনন সারাবছরই চলমান থাকায় হ্রদের পানির সঙ্গে সঙ্গে এর উৎপাদনও বৃদ্ধি পায়।

গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে কাচকি ও চাপিলা মাছের অবতরণের পরিমাণ ছিল প্রায় ৫২০০ টনের মত, সেখান থেকে আমরা প্রায় ১১ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করেছি।

গত মৌসুমে কাপ্তাই হ্রদ থেকে ৫ হাজার ৫০৪ টন মাছ অবতরণ হয়েছে। যার মধ্যে কাচকি ও চাপিলা মাছ অবতরণ হয়েছে প্রায় ৫ হাজার টন। প্রতি কেজি কাচকি ও চাপিলা থেকে সরকার রাজস্ব আদায় করে ২০ টাকা হারে।

উল্লেখ্য, ২০২২-২৩ মৌসুমে কাপ্তাই হ্রদ থেকে ৫ হাজার টন কাচকি ও চাপিলা মাছ অবতরণ করা হয়েছে। রাজস্ব আদায় প্রায় ১১ কোটি টাকা। ২০২১-২২ মৌসুমে অবতরণ হয় ৬১৭৭ টন, রাজস্ব আদায় হয়েছে প্রায় সাড়ে ১১ কোটি টাকা। এছাড়া ২০২০-২১ মৌসুমে ৬ হাজার ৪৫৫ টন কাচকি ও চাপিলা অবতরণ হয়। যা থেকে প্রায় ১২ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d