আলোচনায় তৃতীয়পক্ষ, চলছে ‘ভেরিফিকেশন’
অবশেষে আন্তর্জাতিক নৌবাহিনীর চাপের মুখে ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়া বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ ‘এমভি আবদুল্লাহ’র মালিকপক্ষের সাথে জিম্মির ৯ দিনের মাথায় যোগাযোগ করেছে জলদস্যুরা। তৃতীয় একটি পক্ষের মাধ্যমে আলোচনাও শুরু হয়েছে। এখন চলছে ‘ভেরিফিকেশন’। প্রথমে দুপক্ষ নিশ্চিত হবে তারা সঠিক মানুষের সঙ্গে আলোচনা করছেন কিনা। এটি নিশ্চিত হওয়ার পরেই দরকষাকষি, মুক্তিপণ পৌঁছে দেয়ার মাধ্যম নিয়ে আলোচনা হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই দর কষাকষির প্রক্রিয়াটি পুরোটাই মনস্তাত্ত্বিক এবং সময়সাপেক্ষ বিষয়। তবে এ সময় উভয়পক্ষকেই যথেষ্ট ধৈর্যধারণ করতে হবে। মালিকপক্ষের সামনে এখন মূলত দুটি টার্গেট। একটি মুক্তিপণকে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা এবং অপরটি টাকার অঙ্ক ইন্স্যুরেন্স কাভারেজের মধ্যে রাখা। এই দুটি বিষয়কে মাথায় রেখেই সমঝোতায় পৌঁছাবে জাহাজের মালিকপক্ষ। তবেই জাহাজসহ নাবিকদের মুক্তি দেবে দস্যুরা।
জলদস্যুদের সাথে যোগাযোগ হলেও আলোচনা হয়নি জানিয়ে আজ (বুধবার) দুপুরে জাহাজের মালিকপক্ষ কেএসআরএম গ্রুপের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম জানিয়েছেন, জলদস্যুদের সাথে আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে। যেহেতু বিষয়টি স্পর্শকাতর, তাই আলোচনা না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাবে না।
আন্তর্জাতিক নৌবাহিনীর চাপের মুখেই জলদস্যুরা যোগাযোগ করতে বাধ্য হয়েছে এবং মুক্তিপণ চাওয়াই তাদের লক্ষ্যে উল্লেখ করে মার্চেন্ট নেভির ক্যাপ্টেন আতিক ইউএ খান সিভয়েস২৪-কে বলেন, তারা হয়তো বুঝতে পেরেছে এবার বেশী সময়ক্ষেপণ করা যাবে না, যা তাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হবে। আন্তর্জাতিক নৌবাহিনীর শক্তি দিন দিন বৃদ্ধি পেতে পারে, আরো যুদ্ধজাহাজ তাদের আশপাশে অবস্থান নিতে পারে।
তিনি বলেন, এই যোগাযোগ এটাও প্রমাণ করে যে, মুক্তিপণ চাওয়াই তাদের একমাত্র লক্ষ্য। তাই এই যোগাযোগ খুবই পজিটিভ ব্যাপার। মালিকপক্ষ এবং ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি ইতিমধ্যেই জানিয়েছে, তারা আলোচনা শুরুর জন্য সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। এখন দুইপক্ষের হয়েই দর কষাকষি করবেন তৃতীয় পক্ষের বিশেষজ্ঞ প্যানেল। এই দর কষাকষি কিছুটা সময় নিতে পারে। এসময় সবপক্ষকেই ধৈর্য ধারণ করতে হবে। এটা একটা মনস্তাত্ত্বিক লড়াই, যার মূল লক্ষ্য মুক্তিপণকে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা, যেন সেটা ইন্স্যুরেন্স কাভারেজের মধ্যেই থাকে এবং মালিকপক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়।
এই ক্যাপ্টেন বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে দুইপক্ষই নিশ্চিত হবে তারা সঠিক মানুষের সাথে আলোচনা শুরু করেছেন কিনা। এই বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পরেই ধাপে ধাপে হবে দর কষাকষি। দুইপক্ষ শেষ পর্যন্ত যে অঙ্কের মুক্তিপণে সম্মত হবেন, সেই পরিমাণ নগদ ডলার চাহিদা অনুযায়ী নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দিতে হবে। আলোচনা শুরু হচ্ছে, এটাই আমাদের জন্য আশাব্যঞ্জক সংবাদ।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএমওএ) সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বলেন, যোগাযোগ শুরুর দিকটি ইতিবাচক। মালিকপক্ষ ও বিমাকারী প্রতিষ্ঠান জলদস্যুদের সঙ্গে আলোচনা করে একটি সমঝোতায় পৌঁছাবে বলে তিনি আশা করছেন।
গত ১২ মার্চ বাংলাদেশ সময় বেলা একটার দিকে ‘এমভি আবদুল্লাহ’ ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়ে। সশস্ত্র জলদস্যুরা মাত্র ১৫ মিনিটে ২৩ নাবিককে জিম্মি করে জাহাজটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। পরবর্তীতে ২৭ মার্চ এমভি আবদুল্লাহ দখল করে রাখা জলদস্যুদের জন্য ‘খাত’ নামের এক ধরনের মাদক নিয়ে যাওয়ার সময় একটি নৌযান জব্দ করার কথা জানিয়েছিল পান্টল্যান্ড পুলিশ।
এদিকে বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজটি এবং জিম্মি নাবিকদের জলদস্যুদের হাত থেকে মুক্ত করতে সোমালিয়ার পান্টল্যান্ড পুলিশ এবং আন্তর্জাতিক নৌবাহিনী অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে পান্টল্যান্ড অঞ্চলের পুলিশের বরাতে রয়টার্সে খবর এসেছে।
সোমালিয়ার একটি আধা-স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল পান্টল্যান্ডে রয়েছে অনেকগুলো জলদস্যু দলের ঘাঁটি। ওই এলাকার পুলিশ বাহিনী বলছে, এমভি আবদুল্লাহকে দখল করে থাকা জলদস্যুদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নৌবাহিনীর অভিযানের একটি পরিকল্পনা তারা জানতে পেরেছে। সে কারণে তারা সতর্ক অবস্থানে রয়েছে এবং অভিযানে অংশ নিতেও প্রস্তুত রয়েছে।
পূর্ব আফ্রিকা উপকূলে জলদস্যুতা নির্মূলে কাজ করে যাওয়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন নেভাল ফোর্স তাদের ‘অপারেশন আটলান্টার’ অংশ হিসেবে এমভি আবদুল্লাহর ওপর নজর রাখছে।
ইউরোপীয় এই বাহিনী আবদুল্লাহর জিম্মি নাবিকদের উদ্ধারে অভিযান চালানোর প্রস্তাব দিলেও বাংলাদেশ সরকার তাতে সায় দেয়নি বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের সচিব খুরশেদ আলম আগে জানিয়েছিলেন।
অবসরপ্রাপ্ত এই রিয়ার অ্যাডমিরাল একটি টেলিভিশনের আলোচনায় বলেছিলেন, নাবিকদের জীবনের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই অভিযানের ওই প্রস্তাবে সরকার ও মালিকপক্ষ রাজি হয়নি।
সম্প্রতি এমভি আবদুল্লাহ’র ওপর আন্তর্জাতিক নৌবাহিনীর নজরদারিতে চাপের মুখে পড়েছে জলদস্যুরা। কয়েকটি যুদ্ধজাহাজ দেড় মাইলের মধ্যে ঘেঁষতে থাকায় উপকূলের আরও কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছে জাহাজটি।