রমজানে দানের ক্ষেত্রে যে বিষয় জানা জরুরি
কেউ দান-সদকা করতে করতে দেউলিয়া হয়ে গেছেন এমনটা শোনা যায় না। দান-সদকা কাউকে দেউলিয়া করে না বরং সম্পদ বৃদ্ধি করে। হজরত নবী করিম (সা.) ছিলেন সবচেয়ে দানশীল। রমজান মাসে তার দানশীলতা অনেক বেড়ে যেতো।
হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত, রমজান মাসে অন্যান্য মাসের তুলনায় হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) অনেক বেশি দান করতেন। আমাদের সমাজের মানুষও রমজান মাসে দান-দক্ষিণা করার চেষ্টা করেন।
অন্য যেকোনো ইবাদতের চেয়ে দান একটু বেশি স্পর্শকাতর। তাই আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য দান-সদকার ক্ষেত্রে কিছু বিষয় মনে রাখা দরকার। সেগুলো হলো-
এক. রমজানে সকল আমলের প্রতিদান বহুগুণে বেশি। আর এ জন্যই আল্লাহর রাস্তায় খরচের বিষয়ে দেরি করা উচিত নয়। কেননা আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! আমি তোমাদেরকে যে রুজি দিয়েছি, সেদিন আসার পূর্বেই তোমরা তা থেকে ব্যয় করো, যাতে না আছে বেচা-কেনা, না আছে সুপারিশ কিংবা বন্ধুত্ব। আর কাফেররাই হলো প্রকৃত জালেম। ’ -সূরা বাকারা: ২৫৪
আল্লাহর রাস্তায় খরচে পরকালীন প্রতিদানের পাশাপাশি ইহকালীন প্রতিদানও রয়েছে। এ সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যারা স্বীয় ধন-সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে, এরপর ব্যয় করার পর সে অনুগ্রহের কথা প্রকাশ করে না এবং কষ্টও দেয় না, তাদের জন্যে তাদের পালনকর্তার কাছে রয়েছে পুরস্কার এবং তাদের কোনো আশংকা নেই, তারা চিন্তিতও হবে না। ’ -সূরা বাকারা: ২৬২
অভিজ্ঞজনদের কথা হলো- নিজ মন থেকে ভয়, আশংকা ও দুর্ভাবনা দূর করতে চান? তবে বেশি বেশি আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করুন।
দুই. আল্লাহর রাস্তায় খরচের বিনিময় কেমন হবে এ বিষয়ে আল্লাহতায়ালা পূর্বে উল্লেখিত আয়াতে (সূরা বাকারা: ২৬১) শস্য বীজের উদাহরণ দিয়েছেন। বলেছেন, আল্লাহর রাস্তায় খরচের উদাহরণ একটি বীজের মতো- যা থেকে সাতটি শীষ জন্মায়। প্রত্যেকটি শীষে একশ’ করে দানা থাকে। এ থেকে দানকারী ব্যক্তির দানের বিনিময় আল্লাহ বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেবেন সেদিকে ইঙ্গিত করেছেন।
ইসলামি স্কলাররা আল্লাহতায়ালার দেওয়া শস্য বীজের উদাহরণ প্রসঙ্গে বলেন, দান অনেকটা শস্য উৎপাদনের মতো। তাই দান প্রসঙ্গে শস্যের উদাহরণ টানা হয়েছে। তারই আলোকে তারা বলেন, সদকা থেকে উত্তম বিনিময় পেতে বেশ কিছু বিষয় লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। শস্য বীজ যখন মাটিতে বপন করা হয়, তখন সে বীজ থেকে উত্তম ও আশানুরূপ শস্য তখনই আসে যদি তাতে এই কয়েকটি বিষয় বিদ্যমান থাকে-
ক. বীজভালো হতে হবে অর্থাৎ বীজ যদি পোকা খাওয়া হয় তবে যতো যত্নই করা হোক না কেন, ফলাফল শূন্য। এখানে উলামায়ে কেরাম নিয়তের কথা বুঝিয়েছেন অর্থাৎ আল্লাহর কাছ থেকে উত্তম বিনিময় পেতে নিয়ত সহিহশুদ্ধ হতে হবে। বিশুদ্ধ নিয়ত উত্তম বীজস্বরূপ।
. পাথরের ওপর বা অনুর্বর ভূমিতে রোপিত বীজ যতই ভালো হোক না কেন, ফলাফল শূন্য। সুতরাং অনেক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আজকাল সদকার টাকা সংগ্রহ করে, আমাদের সাধ্যমতো দেখা দরকার আসলে আমাদের সদকা কোথায় যাচ্ছে বা তারা কিভাবে তা খরচ করছে। ব্যক্তিগতভাবে দান করার ক্ষেত্রেও দেখা দরকার প্রকৃত অভাবী ব্যক্তি বা প্রকৃত হকদার ব্যক্তি কে। সদকাগ্রহণকারী বীজ রোপনকৃত ভূমিস্বরূপ।
গ. বীজ বপনের ক্ষেত্রে আরও একটি বিষয় লক্ষণীয় তা হলো- পারিপার্শ্বিক পরিবেশ। পারিপার্শ্বিক উপযোগী পরিবেশে বীজের ফলন ভালো হয়। তেমনিভাবে দানকারী ব্যক্তির সামর্থের সাথে দানের সওয়ার কমবেশ হওয়া নির্ভর করে। দানকারী ব্যক্তি যদি নিজের অঢেল সম্পদ থেকে অতি সামান্য কিছু দায়সারাভাবে দান করেন, তবে সেই দান আর সুখে-দুঃখে সর্বাবস্থার দান এক নয়। কোরআনে কারিমে জান্নাতি লোকদের আলামত প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেছেন, যারা সুখে-দুঃখে সবসময় দান করে। সুতরাং এ বিষয়টিও খেয়াল রাখা উচিত।
তিন. আমরা অনেক সময় কাউকে কিছু দান করার পর তার কাছে দোয়া চেয়ে থাকি। এটা একটা রীতি হয়ে গেছে। এ বিষয়ে ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, যে ব্যক্তি অভাবগ্রস্থকে সাহায্য করে তার কাছ থেকে দোয়া বা অন্য প্রতিদান আশা করলো- সে নিঃসন্দেহে কোরআনের নিন্মোক্ত আয়াতের ওপর আমল করলো না।
আয়াতটি হলো- ‘তারা বলে, কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে আমরা তোমাদেরকে আহার্য প্রদান করি এবং তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান ও কৃতজ্ঞতা কামনা করি না। ’ -সূরা আদ দাহর: ৯
উপরোক্ত আয়াতের ওপর ভিত্তি করে হজরত আয়শা (রা.) যখন কারও মাধ্যমে কোনো দান বা সদকা বন্টন করতেন, তখন বন্টনকারীকে বলে দিতেন; যাকে এ দান বা সদকা দেবে শুনবে সে আমাদের জন্য কি দোয়া করেন। আর এটা এ জন্য যে আমরাও যেনো তার জন্য অনুরূপ দোয়া করতে পারি, যাতে করে আমাদের দানের প্রতিদান আল্লাহর কাছে জমা থেকে যাবে।
চার. যে ১০ জন সাহাবা দুনিয়াতে জান্নাতের সুসংবাদ পেয়েছিলেন তাদের একজন হজরাত জুবায়ের (রা.) বলেন, গোপন গোনাহের কাফফারা হিসেবে বেশি বেশি গোপন সদকা করো। নিজ স্ত্রী বা স্বামীও জানবে না, সন্তানও নয় এমনকি পরিবারের কেউই জানবেন না সদকা দেওয়া হচ্ছে। যাকে দেওয়া হচ্ছে তিনিও অনেক ক্ষেত্রে জানেন না, কে তাকে দান করেছেন। শুধু আল্লাহতায়ালাই জানবেন, তাকে খুশি করতেই এই প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা।
মুনাফিক কখনও গোপনে সদকা করতে পারে না। কেননা তার প্রাপ্তির বিষয়ে সে সন্দিহান, তাই সে নগদ প্রাপ্তি চায় অর্থাৎ মানুষের বাহবা নিতে চায়।
সাহাবাদের সময় মদিনার নিকটবর্তী স্থানে কিছু লোক বসবাস করতো- যারা অভাবী ছিল। তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় চাহিদাগুলো আসতো অজ্ঞাত কোথাও থেকে। হজরত হোসাইন ইবনে আলি (রা.)-এর ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত কেউ জানতো না কার মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা তাদের অভাব মোচন করছেন। এরূপ ছিল তাদের গোপন সদকা।