শঙ্কা নিয়েই সরকার গড়ছেন মোদি, ৮ তারিখে শপথ
আবারও ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি। তার দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এবার এককভাবে সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়সংখ্যক আসন না পেলেও তাদের নেতৃত্বে থাকা জোট ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স (এনডিএ) সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। ফল ঘোষণার দিন কংগ্রেস জোটের বিপুল সাফল্য কয়েক ঘণ্টার জন্য কিছুটা সংশয় তৈরি করলেও গতকাল অবসান হয়েছে সেই সংশয়ের। বিশেষ করে অন্ধ্র প্রদেশের তেলেগু দেশম পার্টির (টিডিপি) প্রধান চন্দ্রবাবু নাইডু এবং বিহারের জনতা দল ইউনাইটেডের (জেডি-ইউ) প্রধান নিতিশ কুমারকে নিয়ে সংশয় ছিল বিজেপির মধ্যেই। তবে জোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত হওয়ার পর তাদের দুজনকেই ফোন করেন অমিত শাহ, জেপি নাড্ডার মতো নেতা।
বুধবার (৫ জুন) দিল্লিতে নিতিশ আর নাইডুকে নিয়েই এনডিএ জোটের শীর্ষ নেতারা বৈঠক করেন। মোদির বাসভবনে ওই বৈঠকে মোদির নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠনের বিষয়ে একমত হয়েছেন নেতারা। পাশাপাশি মোদিকে জোটের নেতাও নির্বাচিত করা হয়েছে।
বৈঠকের পরপরই ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদি মুর্মুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে রাষ্ট্রপতি ভবনে যান মোদি। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ফের সরকার গঠনের দাবি জানান। ভারতীয় গণমাধ্যম এনডিটিভি জানিয়েছে, গত শনিবার মোদি তৃতীয় মেয়াদে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করতে পারেন। এমনটি হলে তিনি হবেন কংগ্রেসের বলিষ্ঠ নেতা ও ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহরুর পর টানা তিনবার প্রধানমন্ত্রী হওয়া একমাত্র নেতা।
তবে নিজেকে ‘ঈশ্বরের প্রতিনিধি’ দাবি করা মোদি এ দফায় প্রধানমন্ত্রী হয়ে আগের মতো বলিষ্ঠ থাকতে পারবেন না বলেই মনে করছেন দেশটির রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। কারণ, এবার ভোটে মোদি ও তার দল বিজেপি জয়ী হয়েও পরাজয়ের বিষাদে পড়েছে। নিজেদের বিপুল উত্থানের স্বপ্ন দেখা দলটি হঠাৎ করে এতটা নেমে যাওয়ার শঙ্কা কল্পনায়ও আনেনি কখনো। আরেকটি বিষয় কংগ্রেসের উত্থান। আশার চেয়ে বেশি ভালো করার বিরোধী জোটও এখন আগের চেয়ে চাঙ্গা।
গত দশ বছর মোদি তথা বিজেপি সরকার তাদের সঙ্গে যে আচরণ করেছে, এই মেয়াদে তেমনটি আর সম্ভব হবে না। আর সবচেয়ে বড় কথা যে নিতিশ ও নাইডুকে নিয়ে সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন মোদি, সেই দুজনের সঙ্গে বারবার সম্পর্কের উত্থান-পতন হয়েছে বিজেপির। ফলে আপাতত তারা সরকার গঠনের জন্য মোদিকে সমর্থন দিলেও যেকোনো সময়, যেকোনো ইস্যুতে এনডিএ জোট ছাড়তে পারেন। ফলে সে সময় সরকার টেকানো নিয়েই বিপদে পড়তে হবে মোদিকে।
বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নিতিশ কুমার একটা সময়ে বিজেপির জোটসঙ্গী থাকলেও তিনি কয়েক বছর আগে এনডিএ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন এবং বিজেপিবিরোধী দলগুলোকে নিয়ে ‘ইনডিয়া’ জোট গঠনের অন্যতম কারিগরও ছিলেন তিনি। তবে এ বছরের জানুয়ারিতে আবারও জোট বদল করে এনডিএ জোটে যোগ দেন তিনি। ঘটনাচক্রে, নিতিশের মতো চন্দ্রবাবু নাইডুও কিছুদিন আগে মোদিবিরোধী অবস্থানে ছিলেন। সে কারণেই এনডিএ জোটে তারা এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন। প্রবীণ সাংবাদিক সঞ্জীব শ্রীবাস্তব বলছেন, ‘নিতিশ কুমার এবং চন্দ্রবাবু নাইডুর ক্রাচ ছাড়া এ সরকার চলতে পারবে না এবং নিতিশ কুমার তো হাওয়ার দিক বদলের মতো জোট বদলিয়ে ফেলেন। এখন এই দুটি ক্রাচ বিজেপির গলায় ঘণ্টার মতো হয়ে গেছে। তারা দুজনেই পুরনো ওস্তাদ খেলোয়াড় এবং অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ। দুজনেরই একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা রয়েছে। এই ক্ষমতার সমীকরণে তারা নিজেদের পাওনা গণ্ডায় বুঝে নেবেন। তারা নিজেদের দাবি তুলে ধরে বলবেন যে আমাদের এটা চাই, তবেই জোটে থাকব।’
গত ১০ বছর যখন সরকার চালিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি, তখন ক্ষমতা পুরোটাই তার এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের হাতেই থেকেছে, অন্য কেউ ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিলেন না। কিন্তু এখন জোট সরকার হলে সেখানে অন্যরাও অংশগ্রহণ করবে, তাদের কথাও শুনতে হবে, তবেই সরকার চলতে পারবে। সঞ্জীব শ্রীবাস্তব বলেন, এর অর্থ হলো জোট ধর্ম মেনে, বাজপেয়ি মডেল যদি গ্রহণ করা হয়, তবেই সরকার চালানো সম্ভব হবে। তবে মোদির জীবনেও এই মডেলে কাজ করার কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। গত ২২ বছরে তিনি তিনবার গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী এবং দুবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে একরকম একচ্ছত্র আধিপত্য নিয়ে কাজ করেছেন। এখন হঠাৎ করে সমন্বয় করে, ঐকমত্যের ভিত্তিতে রাজনীতি করা তার কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। এই নতুন কাজের ধরন তিনি কতটা গ্রহণ করতে পারবেন, তার ওপরই এ সরকারের স্থায়িত্ব নির্ভর করছে।
অটল বিহারি বাজপেয়ির সরকার যখন গঠিত হয় ১৯৯৯ সালে, তখন এনডিএ জোটে ২৪টি দল ছিল। সেই সরকার টিকেছিল পাঁচ বছর। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, জোটের মধ্যে সমন্বয়ের ক্ষমতাই বাজপেয়ি সরকারকে পাঁচ বছর টিকিয়ে রেখেছিল।
আরেকটি বিষয় বিজেপি ভোটের আগে ৪০০ আসন জেতার যে স্লোগান তুলেছিল, সেটি ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির বিস্তর তফাতে গেরুয়া শিবিরের বিপুল বিজয়ের গলাবাজি থেমে গেছে। অন্যদিকে হেরে গিয়েও জয়োৎসবে মাতে বিরোধীরা। ইনডিয়া জোটটি হয়তো সরকার গঠন করতে পারছে না কিন্তু ভারতের রাজনীতিতে কংগ্রেসের প্রবলভাবে ফিরে আসা, রাহুল গান্ধীর জননেতা হয়ে ওঠা এবং গণতন্ত্র ‘সচল’ হওয়ার এই ভোট গোটা দেশের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে। আগামী মেয়াদে পদে পদে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে বিজেপি সরকারকে। কথায় কথায় বিরোধীদের কটাক্ষ করার প্রবণতাও কমবে বিজেপি নেতাদের। লোকসভার ভেতরে-বাইরে জনরায়ের প্রবল শক্তি নিয়ে প্রতিরোধ করার সাহস এই নির্বাচন থেকেই পেয়ে গেছে বিরোধীরা। আগামীতে প্রতিবাদ করতে গিয়ে হয়তো সংঘাতের ঘটনাও ঘটবে। বিরোধী দলের নেতাদের ধরপাকড় হবে। কারাগারে থাকতে হবে। বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, ওইসব ঘটনাই শুরু হবে বিজেপির পরাজয়ের শুরু। আবার কেউ বলছেন, আসলে একদশক ধরে দুর্বল থাকা কংগ্রেসের সবল ও প্রবলভাবে সক্রিয় হয়ে উঠতে পারাটাই বিজেপির ভবিষ্যতের জন্য হুমকি।’