ভোটের পরে কেন অযোধ্যার হিন্দুদের ‘গাদ্দার’ বলছে অন্য হিন্দুরা?
ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর থেকেই উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যার হিন্দুদের নিয়ে অশ্লীল মন্তব্যের ঢেউ দেখা যাচ্ছে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে। অশ্রাব্য গালাগালি তো দেওয়া হচ্ছেই, যার মধ্যে সবচেয়ে ‘ভদ্র’ শব্দটি সম্ভবত ‘গাদ্দার’ বা বিশ্বাসঘাতক।
অযোধ্যা যে লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত, সেই ফয়েজাবাদে বিজেপির প্রার্থী, যিনি আবার আগের বার সংসদ সদস্যও ছিলেন, সেই লাল্লু সিং সমাজবাদী পার্টির প্রার্থী ও দলিত সমাজের প্রতিনিধি অওধেশ প্রসাদের কাছে পরাজিত হওয়ার পর থেকেই সেখানকার বাসিন্দা হিন্দুদের প্রতি ঘৃণা ছড়ানোর পোস্ট, ভিডিও দেখা যাচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে।
এদের বক্তব্য, যে নতুন রামমন্দির সেখানে বানানো হয়েছে, হিন্দু সমাজের অতি গুরুত্বপূর্ণ তীর্থক্ষেত্র হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে, সেখানকার হিন্দু ভোটাররা কেন বিজেপি প্রার্থীকে ভোট দিয়ে জেতাতে ব্যর্থ হলেন!
যারা ওইসব পোস্ট বা ভিডিও বা পোস্টার বানাচ্ছেন, সামাজিক মাধ্যমে তাদের অন্যান্য মন্তব্য বা পোস্ট দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে তারা কট্টর হিন্দুত্ববাদী চিন্তাভাবনায় বিশ্বাস করেন।
অবশ্য ভোটের ফল ঘোষণার পরে অযোধ্যার হিন্দুদের গালাগালি দেওয়া একটি ভিডিও বানিয়ে ঘৃণা ছড়ানোর অভিযোগে পুলিশ ইতোমধ্যেই দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে।
অযোধ্যার স্থানীয় সাংবাদিকরা বলছেন, ৪ জুন ভোট গণনার পর থেকে অযোধ্যা পুলিশের সাইবার শাখায় বহু অভিযোগ জমা পড়ছে সেই সব কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের বিরুদ্ধে, যারা সেখানকার ভোটারদের গালাগালি করছেন, অর্থনৈতিকভাবে বয়কট করার কথা বলছেন।
কী ধরনের পোস্ট দেখা যাচ্ছে
ফেসবুক, এক্স (সাবেক টুইটার), ইনস্টাগ্রাম– এই তিনটি জনপ্রিয় সামাজিক প্ল্যাটফর্মেই চোখে পড়ছে অযোধ্যা হ্যাশট্যাগ দিয়ে সেখানকার ভোটারদের গালাগালি করা হচ্ছে, বিজেপি প্রার্থীর পরাজয়ের জন্য তাদের দায়ী করা হচ্ছে।
সবচেয়ে বেশি যে শব্দটা ব্যবহার করা হচ্ছে তাদের সম্বন্ধে, সেটা হলো ‘গাদ্দার’ বা বিশ্বাসঘাতক।
‘ইন্ডিয়া২০৪৭’ নাম ধারী একটি এক্স হ্যান্ডেলে লেখা হয়েছে, ‘ভগবান রাম যে রাবণের লঙ্কায় ভাল্লুক আর বাঁদরদের সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। অযোধ্যার হিন্দুদের যদি সঙ্গে নিয়ে যেতেন, তাহলে এই ***রা সোনার লোভে রাবণের হয়ে লড়াই করত।’
এই পোস্টের সঙ্গে ‘উত্তরপ্রদেশের গাদ্দার’ হ্যাশট্যাগ দেওয়া হয়েছে। এই ‘এক্স’ হ্যান্ডেল থেকে এরকমই বক্তব্য দেওয়া অন্য অনেকের পোস্ট শেয়ারও করা হয়েছে। কপিল পণ্ডিত নামের আরেক ‘এক্স’ ব্যবহারকারী অযোধ্যাবাসীদের প্রতি তার বিষোদ্গার প্রকাশ করে ফেলেছিলেন ভোট গণনা চলাকালীনই।
তিনি লিখেছিলেন, ‘যে সরকার অযোধ্যাকে ঝকঝকে করে তুলল, নতুন বিমানবন্দর দিলো, রেল স্টেশন দিলো, ৫০০ বছর পরে রামমন্দির বানিয়ে দিলো, একটা পুরো মন্দির অর্থনীতি গড়ে দিলো, সেই দলকেই অযোধ্যাজি আসনে লড়াই করতে হচ্ছে! অযোধ্যাবাসী, লজ্জাজনক!’
ওই একই ব্যক্তি ভোটের ফল বেরনোর পরের দিন একটি ভিডিও পোস্ট করেছেন, যেখানে অযোধ্যার হিন্দুদের অশ্রাব্য গালাগালি করা হয়েছে। আর সেই ভিডিওর ওপরে লেখা হয়েছে ‘লজ্জাও করে না অযোধ্যার হিন্দু তোমরা তো দেখা যাচ্ছে দেশের সবথেকে বড় **! দুর্ভাগ্য একেই বলে অযোধ্যায় রামকে যারা নিয়ে এল, তারা হেরে গেল আর রামভক্তদের ওপরে গুলি চালিয়েছিল যারা তারা জিতল।’
আবার ‘র্যান্ডমসেনা’ নামের আরেকটি এক্স হ্যান্ডেলে পাশাপাশি দুটি ছবি দেওয়া হয়েছে – একটি যে অস্থায়ী তাঁবুতে ১৯৯২ সাল থেকে রামের পুজো হয়- সেটির, আরেকটি নতুন রামমন্দিরের।
ছবি দুটির ওপরে লেখা হয়েছে, ‘অযোধ্যার হিন্দুরা তো সত্যিই *।’
ফেসবুকেও এ ধরনের বহু পোস্ট দেখা যাচ্ছে। যেমন প্রমোদ কুমার পণ্ডিত নামে এক ফেসবুক ব্যবহারকারী একটি ভিডিও পোস্ট করেছেন। সেখানে তিনি বলছেন, ‘এই যে হিন্দু ভাইয়েরা, আজ বুঝতে পারছেন তো যে কেন ৫০০ বছর ধরে অযোধ্যায় রামমন্দির তৈরি করা যাচ্ছিল না? এর জন্য দায়ী অন্য কেউ নয়– একমাত্র অযোধ্যার হিন্দুরাই দায়ী– শুধুমাত্র অযোধ্যার হিন্দুরা।’
অর্থনৈতিক বয়কটের ডাক
‘এক্স’ এবং ইনস্টাগ্রামের একাধিক পোস্টে দেখা যাচ্ছে, অযোধ্যার রামমন্দির ঘিরে যে ‘মন্দির অর্থনীতি’ রয়েছে, তা বয়কট করার আহ্বান জানানো হয়েছে। এক নারীর ভিডিও বক্তব্য রিপোস্ট করেছেন ধর্মেশ নামের এক এক্স ব্যবহারকারী।
এখানে বলে দেওয়া দরকার ‘ধর্মেশ’ নামে ওই এক্স হ্যান্ডেলটি এ ধরনের বেশ কিছু রি-পোস্ট করেছেন যেখানে অযোধ্যার ভোটারদের বিষোদগার করা হয়েছে, কিন্তু তিনি ওইসব মন্তব্যের বিরোধিতা করার জন্যই সেগুলো রিপোস্ট করেছেন, তা স্পষ্টতই দেখা গেছে।
ধর্মেশ হ্যান্ডেলে যে নারীর ভিডিও রিপোস্ট করা হয়েছে, সেখানে তিনি বলছেন- এরপরে কেউ যদি অযোধ্যার মন্দির দর্শন করতে যান, তাহলে বাড়ি থেকে প্রসাদ নিয়ে যাবেন। অযোধ্যার বাসিন্দাদের বানানো প্রসাদ দেওয়ার দরকার নেই। আর রাতে সেখানে থাকবেনও না। কারণ রাতে থাকার অর্থ সেখানকার মানুষদের অর্থনৈতিক লাভ হবে।
অযোধ্যায় নতুন মন্দির তৈরি হওয়ার অনেক আগে থেকেই রামচন্দ্রের ছবি, তার পূজার জন্য ফুল-মালা, মিষ্টি ইত্যাদিকে ঘিরে বড়সড় ‘মন্দির অর্থনীতি’ চলে আসছে। সেখানে আবার একটা বড় অংশীদার অযোধ্যার মুসলমানরাও। তাদের তৈরি প্রসাদ, মিষ্টি, ফুল ইত্যাদি নিয়েই বছরের পর বছর পূজা দিয়ে আসছেন হিন্দু ভক্তরা।
এখন মন্দির অর্থনীতির ওপরে নির্ভরশীল হিন্দু-মুসলমান সবাইকেই টার্গেট করছেন বাইরে থেকে সেখানে মন্দির দর্শন আর পূজা দিতে যাওয়া কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা।
ভোটে হারজিত তো থাকেই: বিশ্ব হিন্দু পরিষদ
লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব বারবারই অযোধ্যায় নতুন রামমন্দির নির্মাণের বিষয়টি তুলে ধরেছিলেন, সেটি গড়ে তোলার জন্য কৃতিত্ব কিছুটা অব্যক্তভাবেই আশা করেছিলেন তারা।
তবে ভোটের ফলাফল ঘোষণার সন্ধ্যায় দিল্লিতে বিজেপির সদর দপ্তরে যে ভাষণ দেন মোদি, সেখানে তিনি ‘জয় জগন্নাথ’ বললেও ‘জয় শ্রীরাম’ যে বলেননি, সেটা অনেকেরই কানে লেগেছিল।
ওড়িশা রাজ্যে ক্ষমতায় আসার কারণে ওই রাজ্যের পুরীর জগন্নাথ দেবকে প্রণাম জানাবেন, এটা স্বাভাবিক, কিন্তু রামমন্দির আন্দোলন এবং ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান বিজেপি এবং হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর সঙ্গে সমার্থক।
তবে জয় শ্রীরাম বা রামমন্দিরের প্রসঙ্গ জেনে বুঝেই আনেননি মোদি, এমন একটা ধারণা তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক মহলে– কারণ ওই রামমন্দিরের আসনটিতেই যে তারা পরাজিত। তবে সেই পরাজয়ের জন্য অযোধ্যার বাসিন্দাদের গালাগালি করা বা তাদের ‘গাদ্দার’ বলা অনুচিত বলে মনে করছেন অনেক হিন্দুত্ববাদী নেতাই।
উত্তরপ্রদেশের বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মুখপাত্র এবং অযোধ্যারই বাসিন্দা শরদ শর্মা দীর্ঘদিন ধরে রামমন্দির আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত।
তার কথায়, ‘এখানে দলের প্রার্থীও সংসদ সদস্য থাকার সময়ে খুবই ভালো কাজ করেছে, দলও প্রচুর কাজ করেছে। আবার সরকারও নতুন বিমানবন্দর, রেল স্টেশন গড়ে দিয়েছে। রাস্তা ঘাট চওড়া করা, মঠ-মন্দিরগুলোর সংস্কার– অনেক কাজই হয়েছে। যা উন্নয়ন হয়েছে তা এক সময়ে কল্পনাও করা যেত না।’
‘যদি ভোটের কথা বলেন, তাহলে নির্বাচনে তো হারজিত থাকেই। যে প্রার্থী ভালো কৌশল নিতে পারবে, সেই জিতবে। আর শুধু তো অযোধ্যা নয়, উত্তরপ্রদেশের অনেক আসনেই তো দল হেরেছে। শুধু অযোধ্যার মানুষকে কেন দোষ দেওয়া হবে! দলের প্রার্থী যে চার লাখ ৯৯ হাজার ভোট পেয়েছেন, সেটাও তো এখানকার মানুষই দিয়েছেন!’ বলছিলেন শরদ শর্মা।
তার কথায়, ‘অনেকে কুকথা বলছেন, গাদ্দার বলছেন এখানকার ভোটারদের। এটা অনুচিত হচ্ছে। অযোধ্যার মানুষই সব সময়ে রামমন্দিরের লড়াইতে থেকেছেন এবং আছেন। যারা ওইসব কুকথা বলছেন, তারা বাইরের মানুষ। অযোধ্যার ইতিহাস, ভূগোল নিয়ে তাদের কোনও ধারণা আছে বলে মনে হয় না।’
আবার রামমন্দিরের প্রধান পুরোহিত আচার্য সত্যেন্দ্র দাস বলছেন, নির্বাচনে পরাজয়ের পরে অযোধ্যার মানুষকে যারা দোষ দিচ্ছেন, তারা মূর্খ।
কেন অযোধ্যায় পরাজয় বিজেপির?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন অযোধ্যা যে ফয়েজাবাদ লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত, সেখানে বিজেপির পরাজয়ের মূল কারণ দুটি।
বিবিসির সাবেক সহকর্মী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সমীরাত্মজ মিশ্র বলছিলেন, ‘প্রথমত রামমন্দির নির্মাণের সময়ে উন্নয়নের নামে সেখানে যে ধ্বংসযজ্ঞ চলেছে, মানুষের ঘর-বাড়ি-দোকান নির্বিচারে ভেঙে দেওয়া হয়েছে, বহু মানুষ যথার্থ ক্ষতিপূরণ পাননি, সেই ক্ষোভ তো ছিলই।’
‘দ্বিতীয়ত, বিরোধী জোট এখানে যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে গিয়েছিল। কংগ্রেস আর সমাজবাদী পার্টির জোট হয়েছিল। এই অঞ্চলটা তো দীর্ঘদিন ধরে কংগ্রেসের শক্তিশালী এলাকা ছিলই,’ বলছিলেন সিনিয়র সাংবাদিক মিশ্র।
তিনি আরও বলেন, এবার কংগ্রেস আর সমাজবাদী পার্টি জোট গড়ে এখান থেকে একজন দলিত নেতাকে প্রার্থী করল। ফয়েজাবাদের প্রায় পাঁচ লাখ দলিত ভোট আছে। সেগুলোর বড় অংশ পেয়েছে বিরোধী জোট। এই জাতি-ভিত্তিক সমীকরণের ফলে ভোটের আগে থেকেই আমরা যারা ওই কেন্দ্রে পর্যালোচনার জন্য গিয়েছিলাম, তারা বুঝতেই পারছিলাম যে এই আসনটি বিজেপির পক্ষে খুবই কঠিন আসন হয়ে উঠেছে।