স্বাস্থ্য

হেপাটাইটিস : ছোঁয়াচে না হলেও সহজেই সংক্রমণ, পদে পদে বঞ্চনা

হেপাটাইটিস কোনো ছোঁয়াচে রোগ না হলেও সহজেই এর বিস্তার বা সংক্রমণ ঘটে। প্রতিষেধকের মাধ্যমে ভাইরাসটি প্রতিরোধ করা গেলেও সংক্রমিতরা পদে পদে বঞ্চনার শিকার হন। ফলে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্ত ও চিকিৎসায় গুরুত্ব দিতে হবে।

বৈষম্যের শিকার হেপাটাইটিস পজিটিভ ব্যক্তিদের অধিকার নিশ্চিতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি-বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

এমন প্রেক্ষাপটে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ওয়ার্ল্ড হেপাটাইটিস অ্যালায়েন্সের আহ্বানে অন্যান্য দেশের মতো রোববার (২৮ জুলাই) বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস-২০২৪।’

হেপাটাইটিসের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়াতে এ বছরের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘ইট’স টাইম ফর অ্যাকশন অর্থাৎ ব্যবস্থা গ্রহণের এখনই সময়’।

দিবসটি ঘিরে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সচেতনতামূলক র‌্যলি, আলোচনা সভা, সেমিনার ও হেপাটাইটিস স্ক্রিনিং ক্যাম্পের আয়োজন করেছে।

রোববার (২৮ জুলাই) দুপুর ১২টায় হেপাটোলজি সোসাইটির উদ্যোগে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সদস্যদের নিয়ে একটি সচেতনতামূলক সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে।

দিবসটি উপলক্ষ্যে দেওয়া এক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হেপাটাইটিস নির্ণয়ে পরীক্ষা করা, টিকা গ্রহণ এবং প্রয়োজনে চিকিৎসা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন।

অনিরাপদ রক্ত সঞ্চালন, অনিয়ন্ত্রিত সুঁই, সিরিঞ্জ ব্যবহার ও অনিরাপদ দৈহিক সম্পর্কের মাধ্যমে হেপাটাইটিস ছড়ায়।

নাক-কান ফুটো, সংক্রমিত ব্যক্তির টুথব্রাশ ও শেভিং যন্ত্রপাতি ব্যবহারের মাধ্যমে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। সহজ এই কাজগুলোর ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন ও প্রতিষেধক গ্রহণের মাধ্যমে হেপাটাইটিস প্রতিরোধ করা যায়।

চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলেন, হেপাটাইটিস বা লিভারের প্রদাহ এ, বি, সি, ডি ও ই এই পাঁচ ধরনের ভাইরাসের কারণে হয়ে থাকে। এরমধ্যে হেপাটাইটিস এ ও ই খাদ্য ও পানিবাহিত। যা থেকে স্বল্পমাত্রার জন্ডিস হয়ে থাকে। এটি সাধারণত ৪ থেকে ৮ সপ্তাহের মধ্যে শরীরে ইমিউন সিস্টেমের (রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা) মাধ্যমে সেরে যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক লিভার ফেইলিউর হতে পারে।

হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস পজিটিভ একাধিক রোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিদেশ গমনের ক্ষেত্রে মেডিকেল টেস্টে হেপাটাইটিস পজিটিভ হলে অনেক রাষ্ট্রের ভিসা দেওয়া হয় না। বিসিএসসহ সরকারি চাকরিতে নেওয়া হয় না। কিডনি রোগীর হেপাটাইটিস পজিটিভ হলে বেশিরভাগ হাসপাতালে ডায়ালাইসিস করানো যায় না।

আক্রান্তরা স্বেচ্ছায় রক্তদান, ক্যাডাভারিক ট্রান্সপ্লান্টের জন্য কিডনি দান, মরণোত্তর চক্ষুদানসহ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান করতে পারেন না।

হেপাটাইটিস পরিস্থিতি : দেশে হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস খুবই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।

সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রতিবেদন অনুযায়ী, উচ্চঝুঁকিতে থাকা ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। প্রথমে রয়েছে চীন এবং দ্বিতীয় ভারত। এমন পরিস্থিতিতে নতুন প্রজন্মের সংক্রমণ ও মৃত্যু ঠেকাতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি সুচিকিৎসার সুযোগ বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

এ ছাড়া কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের ২০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক শরণার্থীর শরীরে সক্রিয় হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের সংক্রমণ পাওয়া গেছে।

স্বেচ্ছাসেবী চিকিৎসকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘মেডিসিন্স স্যান্স ফ্রন্টিয়ার্স (এমএসএফ) গত বছরের (২০২৩) মে থেকে জুন কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একটি সমীক্ষা করে। সাতটি ক্যাম্পে ৬৮০টি পরিবারের মধ্যে সমীক্ষাটি করা হয়।

ফলাফলে দেখা যায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে প্রাপ্তবয়স্কদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ তাদের জীবনের কোনো না কোনো সময়ে হেপাটাইটিস সংক্রমণের সংস্পর্শে এসেছিল। এর মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশের মধ্যে সক্রিয় ‘হেপাটাইটিস সি’ সংক্রমণ রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সীমিত পরিসরে চালানো এই সমীক্ষার ফলাফলের সঙ্গে পুরো রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের তুলনা করলে বোঝা যায়, প্রায় পাঁচজন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে একজন বর্তমানে এইচসিভি সংক্রমণের সঙ্গে বসবাস করছেন। সংখ্যার দিক থেকে শরণার্থীদের মধ্যে আনুমানিক ৮৬ হাজার ৫০০ মানুষ ‘হেপাটাইটিস সি’ ভাইরাস সংক্রমণে ভুগছেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশনের প্রধান অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল) বলেন, দেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় এক কোটি হেপাটাইটিস বি এবং ৫ বছরের নিচে ১ শতাংশের (১৬ লাখ ৬০ হাজার) কিছু কম সংখ্যক মানুষ হেপাটইিটস-সি ভাইরাসে আক্রান্ত।

সি ভাইরাস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতিবছর হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাসে ২৩ হাজার মানুষ মারা যান।

এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, হেপাটাইটিস আক্রান্ত রোগীদের কিছু অধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার নয় বরং প্রতিষ্ঠান ও কর্মীরা বাধা তৈরি করেন। যেমন মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ আশিয়ানভুক্ত দেশগুলো হেপাটাইটিস আক্রান্ত কর্মীদের ভিসা দেয় না। আশ্চর্যের বিষয় হলো দেশগুলো স্টুডেন্ট ভিসা দেয়।

এছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে সারা বিশ্ব থেকে বি, সি ভাইরাস এবং লিভার ক্যানসার নির্মূলের কথা বলা হয়েছে। হেপাটাইটিস নির্মূলে সচেতনতার পাশাপাশি জনগণের দোরগোড়ায় চিকিৎসার ব্যবস্থা পৌঁছাতে হবে।

শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলেন, হেপাটাইটিস মানে কর্ম-অক্ষম নয়। কিন্তু অসচেতনতায় আক্রান্তরা পদে পদে বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। তাই দেশে ও বিদেশে চাকরির ক্ষেত্রে হেপাটাইটিস পরীক্ষার বাধ্যবাধকতা তুলে দিতে হবে। রোগ সম্পর্কে সচেতনতার পাশাপাশি চিকিৎসার জন্য হেপাটোলজিস্টদের সংখ্যা বাড়াতে হবে।

অন্তঃসত্ত্বা নারী ও শিশু জন্মের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে টিকা নিশ্চিত করতে হবে। যারা ছোট বেলায় এবং সতের বছরের উপরে যারা টিকা পায়নি তাদের টিকার আওতায় আনতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d