অন্তর্বর্তী সরকারকে নজরে রেখে ছায়া সরকার গঠনের কথা বললেন বিশিষ্টজনরা
অন্তর্বর্তী সরকারকে সমালোচনার মাধ্যমে চোখে চোখে রাখতে হবে বলে জানিয়েছেন বিশিষ্টজনরা। এ লক্ষ্যে তারা একটি ছায়া সরকার গঠনের কথাও বলেন।
সোমবার (১২ আগস্ট) ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটির নসরুল হামিদ মিলনায়তনে ‘ছাত্র-গণ অভ্যুত্থানের অঙ্গীকার, এই রাষ্ট্রের সংস্কার’ প্রতিপাদ্যে ‘ছাত্র-গণ অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব ও অভ্যুত্থানের স্পিরিট রক্ষায় করণীয়’ প্রসঙ্গে আয়োজিত এক সংস্কার সংলাপে বক্তারা এ কথা জানান।
সংস্কার সংলাপের আয়োজন করে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন। সংস্কার সংলাপের সঞ্চালনা করেন রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম।
বক্তারা এ সময় বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে সমালোচনার মাধ্যমে চোখে চোখে রাখার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের যে আকাঙ্ক্ষা সেটাকে ধারণ করে নতুন আরও কিছু যোগ করে গণ বান্ধব সংবিধান তৈরি করতে হবে। যাতে আমাদের সমাজে আর কোনো স্বৈরাচার তৈরি হতে না পারে। সে জন্য এই গণঅভ্যুত্থানকে সামাজিক বিপ্লবে পরিণত করে রাষ্ট্র সংস্কারের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নজরদারি করতে একটি ছায়া সরকার গঠন করতে হবে।
সংস্কার সংলাপে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ২০২৪ এ আমাদের যে অভ্যুত্থান হয়েছে তা ছাত্র, জনতা, রাজনৈতিকদের সমন্বয়ে সর্বজনীন অভ্যুত্থান। এর মধ্যদিয়ে মানুষের পুঞ্জিভূত ক্ষোভের কারণে প্রথম এ দেশের কোনো সরকারকে পালিয়ে যেতে হয়েছে। তবে এখন যে অন্তর্বর্তী সরকার হয়েছে তাদের সমালোচনা করতে হবে, তাদের চোখে চোখে রাখতে হবে। যাতে করে কেউ এদেশে আর স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে না পারে। আমাদের দেশ ৭১, ৭৫, ৯০ সালের পর বেহাত হয়ে গেছে। কিন্তু ২৪ সালে এসে সে অর্জন আমরা বেহাত হতে দিতে পারি না।
রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে আমলাতান্ত্রিক কাঠামো। ব্রিটিশ থেকে শুরু করে পাকিস্তান আমল হয়ে এখন পর্যন্ত এই কাঠামো আমাদের এখানে বড় হয়ে উঠেছে। হাসিনা কিন্তু তার এই আমলাতান্ত্রিক কাঠামোকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। আর কেউ যাতে তা করতে না পাতে সেজন্য আমাদের এর থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
সংস্কার সংলাপে মুক্তিযুদ্ধের যে আকাঙ্ক্ষা সেটাকে ধারন করে নতুন আরও কিছু যোগ করে গণ বান্ধব সংবিধান তৈরি করার কথা জানান ঢাবির ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী মারুফুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমরা যে রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলছি, তা কিন্তু আমাদের সংবিধান পুরোপুরি পাল্টে ফেলার জন্য নয়। আমরা রাষ্ট্রের কিছু কাঠামোর পরিবর্তনের কথা বলছি। যদিও আমাদের এখন যে সংবিধান আছে তা সঠিক হলেও, বর্তমান সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে এই সংবিধান কাজ করছে না। নতুন সংবিধান তৈরির ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের যে আকাঙ্ক্ষা বর্তমান সংবিধানে ছিল সেটাকে নিয়ে আমরা নতুন আরও কিছু যোগ করে গণ বান্ধব সংবিধান তৈরি করতে পারি। যেখানে নাগরিকদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে ও জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী একটি অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সাংবিধানিক কাঠামো তৈরি করতে হবে।
সমাজে আর যেন স্বৈরাচার তৈরি হতে না পারে সে জন্য এই গণঅভ্যুত্থানকে সামাজিক বিপ্লবে পরিণত করতে হবে জানিয়ে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মাহবুব মোর্শেদ বলেন, ২৪ এর এই গণঅভ্যুত্থান বিপ্লবে পরিণত হয়নি। এটাকে বিপ্লবে পরিণত করতে হবে। যাতে করে শেখ হাসিনার মতো কোনো স্বৈরাচার যেন আমাদের সমাজে আর তৈরি হতে না পারে।
অন্তর্বর্তী সরকারকে নজরদারি করতে একটি ছায়া সরকার গঠন করার কথা জানান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নাসির উদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার একটু বেশি তাত্ত্বিক হয়ে গেছে। তাদের প্রথম যে দায়িত্ব পালন করা দরকার তা হচ্ছে বাজারে সুফল দেওয়া। মানুষ যদি এই অন্তর্বর্তী সরকারের সুফল না পায় তাহলে জনগণই এই সরকারের পেছনে পড়বে। পাশাপাশি এই অভ্যুত্থানের ছাত্রদের খুন করেছে যারা সেই দোষীদের সাজার আওতায় আনা ও দুর্নীতিবাজ এবং অর্থ পাচারকারীদের বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। এই সরকার কোথায় ভুল করছে তা দেখার জন্য একটি ছায়া সরকার গঠন করতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র মেরামতে যে সংস্কারের কথা বলছে তাতে অনেক সময় লেগে যাবে। দৈনিক প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি সোহরাব হাসান এ কথা তুলে ধরে বলেন, আমারা যখন রাষ্ট্র সংস্কার করতে চাচ্ছি, সেখানে আমাদের কথারও সংস্কার করতে হবে। আমরা আসলে কি বলতে চাচ্ছি সে কথারও সংস্কারও করতে হবে। সংখ্যালঘুদের প্রতি আমাদের দায়িত্বশীল হতে হবে। আমরা যদি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারি এবং ন্যায়ের কথা বলতে পারি তাহলে সংস্কার সম্ভব হবে। অন্তর্বর্তী সরকারকে নিয়ে আমাদের যেমন আশা আছে তেমন শঙ্কাও আছে। তারা যে সংস্কারের কথা বলছে তাতে রাষ্ট্র মেরামত হতে অনেক সময় লেগে যাবে।
কবি সোহরাব হাসান বলেন, ইতিমধ্যে আমাদের সমাজে দখলদারিত্ব শুরু হয়ে গেছে। যেটা আমাদের সাংবাদিক সমাজেও দেখা যাচ্ছে। আমাদের সামনের দিন অনেক কঠিন। বাংলাদেশের রাষ্ট্র শুধু ৫ শতাংশ মানুষের। বাকি ৯৫ শতাংশ মানুষ প্রতিনিয়ত মৌলিক অধিকারের জন্য লড়াই করে গেছে। তাই রাষ্ট্র সংস্কার করতে হলে এই ৯৫ ভাগ মানুষের কথা মাথায় রেখে সংস্কার করতে হবে। সরকার যদি পুলিশ র্যাব গিয়ে মানুষের ওপর অত্যাচার চালায়, আর সেখানে জনগণ যদি গণরোষের নামে পুলিশের ওপর হামলা চালায় এমন মানসিকতা থাকলে এই রাষ্ট্র সংস্কার সম্ভব না। কোনো রাষ্ট্রে মৌলিক অধিকার নিশ্চিত না হলে সেখানে সংস্কার হয় না।
বাংলাদেশে ৫ বছরের বেশি জনপ্রিয়তা ধরে রাখা কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য সম্ভব না। শেখ হাসিনার সবচেয়ে বড় ভুল ছিল এ দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা। তিনি যদি ক্ষমতা ধরে না রেখে সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করতেন, তাহলে হয়তো এমন অবস্থা আওয়ামী লীগের হতো না।