মিরসরাইয়ে ১৬৫ গ্রামে দুই লাখ মানুষ পানিবন্দী
মিরসরাইয়ে টানা পাঁচ দিনের বন্যায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছে প্রায় দুই লাখেরও বেশি মানুষ। টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে এখানকার ফেনী নদীর পানির উচ্চতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়া গত বুধবার থেকে এখানকার ১১টি ইউনিয়নের প্রায় ১৬৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়। অবশ্য গতকাল সকাল থেকে কিছু কিছু এলাকায় এক থেকে দুই ফুট পর্যন্ত পানি কমেছে। তবে বানের পানিতে ভেসে গেছে এখানকার শত কোটি টাকা মূল্যের মাছ। যা চট্টগ্রামের মৎস্য খাদ্য চাহিদার ৭০ ভাগ পূরণ করতো।
জানা গেছে, একদিকে বন্যায় পানিবন্দী লাখো অসহায় মানুষ। অন্যদিকে ফেনী নদীর ভাটিতে অবস্থিত দেশের বৃহত্তর সেচ প্রকল্প মুহুরীর দুটি গেট পানির তোড়ে ভেঙে গেছে। অকেজো আছে আরো দুইটি গেট। এ কারণে একদিকে জোয়ারের সময় ফেনী নদী হয়ে অভ্যন্তরে ঢুকছে বঙ্গোপসাগরের পানি। আবার ভাটার সময় দুটি গেট অকেজো থাকার কারণে পানি নিষ্কাশন ব্যাহত হচ্ছে।
এদিকে, ১৯৯৪ সালে সরকারের পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) মিরসরাইয়ের জনবসতি রক্ষায় চর ডেভলপমেন্ট প্রজেক্টর আওতায় এখানকার বাঁশখালী ও ইছাখালী মৌজায় ১১.৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে একটি সাগর প্রতিরক্ষা বাঁধ তৈরি করে। যা গত কয়েকদিনের বন্যায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রবিবার বেলা ২টার দিকে বাঁধ এলাকার বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন নিশ্চিত করেন, বাঁধের অনেক স্থানে ফাটল দেখা দিয়েছে। কোথাও কোথাও ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। এতে এলাকার লোকজন চরম আতঙ্কের মধ্যে সময় অতিবাহিত করছে।
অবশ্য এ বিষয় এবং মুহুরি প্রকল্পের গেট ভেঙে যাওয়ার বিষয়ে কথা বলতে ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ রাশেদ শাহরিয়ারকে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেন নি।
গত কয়েকদিনের বন্যায় চট্টগ্রামের মৎস্য উৎপাদনের অন্যতম জোন হিসেবে পরিচিত মুহুরি প্রজেক্ট এলাকার কয়েক হাজর একর মাছের ঘের পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে এখানকার চাষীদের ৫শ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছেন মুহুরি প্রজেক্ট মৎস্য চাষী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ‘বন্যা শুরু হয়েছে গত বুধবার তবে তার পরদিন অথ্যাৎ বৃহস্পতিবার থেকে মাছের ঘের ডুবতে শুরু করে। বর্তমানে এখানকার কয়েক হাজার একর ঘের পানির নিচে। এখানে সরকারি হিসেবে প্রতি বছর ৪৯ হাজার মেট্রিকটন মাছ উৎপাদন হতো। যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। এবারের বন্যায় এগুলোর অর্ধেকেরও বেশি ঘের পানিতে ডুবে সব মাছ পানিতে ভেসে গেছে।
মিরসরাই উপজেলা সিনিয়র মৎস্য অফিসার নাসিম আল মাহমুদ জানান, এ বছর মাছ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিলো ৫০ হাজার মেট্রিকটন। তবে বন্যায় অধিকাংশ মাছের ঘের ডুবে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষিতি হয়েছে। এখনো ক্ষতির হিসেব বলা যাচ্ছে না।
এদিকে গত কয়েকদিন বন্যার কারণে দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন হিসেবে বিবেচিত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সব ধরণের যান চলাচল বন্ধ ছিলো। গতকাল সকাল থেকে ঢাকামুখী লেনে যান চলাচল স্বাভাবিক হতে শুরু করে। তবে গত কয়েকদিন পথে আটকে থাকার দরুন মালবাহী অনেক যানবাহনে থাকা নিত্য প্রয়োজনীয় কাঁচা ভোগ্যপণ্য নষ্ট হয়ে গেছে।
গত ২২ আগস্ট বৃহস্পতিবার কুমিল্লার চান্দিনা বাজার থেকে এক ট্রাক কাঁচা শাক-সবজি নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হন চালক রিয়াজ উদ্দিন। তিনি রবিবার বেলা ১২টার বারইয়ারহাট এলাকায় বলেন, ‘চট্টগ্রামের রিয়াজ উদ্দিন বাজারের কয়েকজন পাইকারি বিক্রেতা কুমিল্লার চান্দিনা বাজার থেকে কাঁচা মরিচ, ধনিয়া পাতাসহ বেশ কিছু শাক-সবজি নিয়ে ট্রাক লোড করেন। কিন্তু গত তিন দিনেরও বেশি সময় ফেনীর লেমুয়া এলাকায় আটকে থাকার দরুন সব কিছু পঁচে নষ্ট হয়ে গেছে।’
মিরসরাইয়ের জোরারগঞ্জ হাইওয়ে থানার পরিদর্শক সোহেল সরকার জানান, রবিবার সকাল থেকে ঢাকামুখী লেন পুরোপুরি চালু হয়েছে। চট্টগ্রামমুখী লেনও স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির খাঁন জানান, রবিবার সকাল ১১টা পর্যন্ত উপজেলার ৭৯টি আশ্রয় কেন্দ্রে ২০ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। অনেকেই আবার আশ্রয় কেন্দ্র থেকে আত্মীয়-পরিজনের বাড়িতেও আশ্রয় নিচ্ছে। কেন্দ্রীয়ভাবে মিরসরাই উপজেলা প্রশাসন ত্রাণ কার্যক্রম মনিটরিং করছে।
উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) প্রশান্ত চক্রবর্তী জানান, শনিবার রাত থেকে রবিবার পর্যন্ত কোন হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। কিছু কিছু এলাকায় পানি কমতে শুরু করেছে। সেনাবাহিনী, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, যুব রেডক্রিসেন্ট এ্যালমনাই, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন এবং শিক্ষার্থীরা পৃথক পৃথকভাবে বানভাসী মানুষদের উদ্ধার এবং তাদের মাঝে বিশুদ্ধ পানীয়, ওষুধ ও খাবার বিতরণ করছেন।
চট্টগ্রাম পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-৩ বারইয়ারহাট জোনাল অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার হেদায়েত উল্যাহ ও মিরসরাই জোনাল অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার আদনান আহমেদ জানান, কিছু কিছু এলাকায় পানির তীব্রতা কমে যাওয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু করা হয়েছে। এখনো বন্যাকবলিত অধিকাংশ এলাকায় বিদ্যুৎসেবা দেয়া যাচ্ছে না।