চট্টগ্রামপার্বত্য চট্টগ্রাম

নেতাকর্মী-সমর্থকদের মুক্তিসহ ৮ দাবি ইউপিডিএফের

খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি জেলে আটক ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মুক্তি দেওয়াসহ আট দফা দাবি জানিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভিত্তিক এ রাজনৈতিক দল।

মঙ্গলবার (২৭ আগস্ট) জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে ইউপিডিএফ আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে এসব দাবি জানান দলটির সংগঠক মাইকেল চাকমা।

‘জামিনে মুক্তদের জেল গেটে পুনরায় গ্রেপ্তার বন্ধ, আনন্দ প্রকাশ চাকমাসহ ইউপিডিএফ ও দেশের রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবি এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান পরিস্থিতি’ বিষয়ে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে মাইকেল চাকমা বলেন, শুধু সমতলে নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামেও হাসিনার সরকার দমনপীড়নের স্টিম রোলার চালায়, যার শিকার হয় প্রধানত ইউপিডিএফ। তার ১৫ বছরের শাসনামলে ইউপিডিএফকে স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক কার্যক্রম চালাতে দেওয়া হয়নি। পার্টির সব অফিস বন্ধ করে দেওয়া হয়। অর্ধ শতাধিক নেতাকর্মীকে বিনা বিচারে হত্যা, গুম ও আরও অনেককে গ্রেপ্তার-নির্যাতন করা হয়েছে। আদালত থেকে জামিন পেলেও জেলগেট থেকে একই বন্দিকে বার বার আটক করে জেলে ফেরত পাঠানো হয়েছে। ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর খাগড়াছড়িতে একটি ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী গঠন করে দেওয়া হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে। এ বাহিনী হাসিনা সরকারের ছত্রছায়ায় ২০১৮ সালের ১৮ আগস্ট স্বনির্ভর গণহত্যা ও ২০২৩ সালের ১১ ডিসেম্বর পানছড়িতে চার যুবনেতা হত্যাসহ অসংখ্য হত্যা, অপহরণ ও গুমের সঙ্গে জড়িত।

তিনি বলেন, অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশ দ্বিতীয়বার স্বাধীন হয়েছে। দেশের মানুষ এখন মুক্ত হাওয়ায় প্রাণভরে নিশ্বাস নিতে পারছে। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ এখনও স্বাধীনতার সেই স্বাদ পায়নি। পাহাড়ে এখনও পরিবর্তনের হাওয়া পৌঁছেনি। সমতলে অন্যায়ভাবে আটক রাজবন্দিরা মুক্তি পেতে শুরু করলেও, পার্বত্য চট্টগ্রামে বন্দি ইউপিডিএফ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের এখনও ছেড়ে দেওয়া হয়নি। এ বন্দিদের অনেকে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বিনা বিচারে কারাগারে আটক। হাসিনার আমলে জামিন পাওয়ার পরও জেল গেট থেকে পুনরায় গ্রেপ্তার করার কারণে তারা এখন নতুন করে আদালতে জামিনের আবেদন করতে সাহস পাচ্ছেন না।

তিনি আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের এক দশমাংশ। তাই স্বাভাবিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাদ দিয়ে দেশে প্রকৃত ও অর্থবহ সংস্কার হতে পারে না। পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাশাসন বা নিপীড়নমূলক অবস্থা জারি রেখে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে গণতন্ত্র কায়েম হওয়া অসম্ভব। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণকে মুক্তি না দিয়ে সমতলের জনগণও প্রকৃত মুক্তি পেতে পারে না। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর থেকে হাসিনার সরকার পর্যন্ত দেশের ইতিহাস তারই প্রমাণ দেয়। কাজেই অন্তর্বর্তী সরকারের যে কোনো সংস্কার পরিকল্পনায় কিংবা গণতন্ত্রায়ণের প্রক্রিয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামকে অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামেও আমূল সংস্কার আনতে হবে। তা না হলে দেশে আবার আগের মতো ফ্যাসিস্ট রাজত্ব কায়েম হতে পারে।

অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে তাদের দাবিগুলো হলো-

১) অবিলম্বে জুলাই-আগস্ট ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের সময় নিহত সব শহীদের নাম প্রকাশ ও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ফ্যাসিস্টদের গ্রেপ্তার করে বিচার নিশ্চিত করা।

২) অবিলম্বে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি জেলে আটক ইউপিডিএফ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মুক্তি দেওয়া; আদালত থেকে জামিন লাভের পর জেল গেট থেকে পুনরায় গ্রেপ্তার বন্ধ করা; এবং ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের আমলে ইউপিডিএফ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের নামে দায়ের করা সব মিথ্যা মামলা ও হুলিয়া প্রত্যাহার করা।

৩) ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে সৃষ্ট ঠ্যাঙাড়ে নব্য মুখোশ বাহিনী ও মগ পার্টি ভেঙে দেওয়া এবং তাদের মধ্যে যারা খুন, গুম, অপহরণ ও সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত তাদের গ্রেপ্তার করে শাস্তি দেওয়া।

৪) স্বনির্ভর গণহত্যা ও পানছড়িতে চার যুব নেতা হত্যাসহ ফ্যাসিস্ট হাসিনার আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত সব হত্যাকাণ্ড ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠন করা এবং তদন্ত এবং বিচার প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘকে যুক্ত করা।

৫) অবিলম্বে নির্দলীয়, সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ দিয়ে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ পুনর্গঠন করা।

৬) অবিলম্বে বান্দরবানে চলমান কেএনএফ-বিরোধী অভিযানের নামে বম জাতিগোষ্ঠীকে নিশানা করে জাতি-নিধন অভিযান বন্ধ করা এবং শিশু ও নারীসহ আটককৃত বমদের মুক্তি দেওয়া।

৭) খাগড়াছড়ির রামগড়ে গৃহবধূকে ধর্ষণকারীদের গ্রেপ্তার ও রাঙামাটি এবং বান্দরবানে ধর্ষণ প্রচেষ্টার সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি দেওয়া।

৮) পার্বত্য চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য অপারেশন উত্তরণ বাতিল করে সেনা শাসন প্রত্যাহার ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ১১ দফা নির্দেশনা বাতিল করা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

লিখিত বক্তব্য শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন মাইকেল চাকমা। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির সংস্কার চান কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যে শান্তি চুক্তি আছে সেটি পরিপূর্ণ নয়। আমরা অবশ্যই এর পরিবর্তন চাই।

ইউপিডিএফ এবং তাদের সমর্থকদের ২৯ জন সদস্য বর্তমানে কারাগারে রয়েছে বলে জানান মাইকেল চাকমা।

জামিনে মুক্তির পর জেল গেটে ইউপিডিএফ এর কতজন কর্মী ও সমর্থককে পুনরায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের তিনজন সমর্থককে জামিনের পর গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে একজনকে তিনবার, একজনকে দুইবার এবং একজনকে চারবার পুনরায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

দীর্ঘদিন আয়না ঘরে বন্দি ছিলেন মাইকেল চাকমা। আয়না ঘর সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আয়না ঘরে অমানবিকভাবে আটকে রাখা হতো। হিটলার যেভাবে তার কনসানটেশন ক্যাম্পে ধরে নিয়ে রাখতো, আয়নাঘর ধরে নিতে পারেন ঠিক তেমন একটি জায়গা। যেখানে মানুষকে তার সব মানবাধিকার লঙ্ঘন করে রাখা হতো।

সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাবেক সভাপতি সুনয়ন চাকমা, ইউপিডিএফ সদস্য থুইখোচিং মারমা প্রমুখ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d