চট্টগ্রাম

প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় : চসিকের সম্পত্তি ছিনতাইয়ের গল্প!

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের অর্থায়নে এবং জমিতে প্রতিষ্ঠিত প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়টি সাত বছরেরও বেশি সময় ধরে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর পরিবারের দখলে রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। চসিকের পক্ষে আদালতের রায় থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তারা বিশ্ববিদ্যালয়টি নিজেদের পারিবারিক সম্পত্তির মতো ব্যবহার করছে। এমনকি দখলকে স্থায়ী করতে ট্রাস্টি বোর্ডে যুক্ত করা হয়েছে এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল আলম মাসুদ ও তার পরিবারের সদস্যদের। এর ফলে চসিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো আয় পাচ্ছে না।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) উদ্যোগে ২০০২ সালে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুমোদন লাভ করে। প্রাথমিকভাবে চসিকের মালিকানাধীন ভবনে এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। পরবর্তীতে, চসিকের তহবিল থেকে ৪৬ কোটি ৯৩ লাখ টাকা ব্যয়ে সিএসসিআর হাসপাতাল ও ওয়াসা মোড়ে অবস্থিত চসিকের জমিতে তিনটি ভবন নির্মাণ করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস স্থাপন করা হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ৬টি অনুষদের অধীনে ১৪টি বিভাগ রয়েছে, যেখানে ৬ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। এছাড়াও এখানে শতাধিক শিক্ষক এবং তিন শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত। বিশ্ববিদ্যালয়টির বার্ষিক বাজেট প্রায় ৭১ কোটি টাকা।

এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রামের মেয়র থাকাকালীন প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০১০ সালে মেয়র নির্বাচনে পরাজিত হলেও তিনি ট্রাস্টি সদস্য হিসেবে থেকে যান। ২০১৫ সালে নতুন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের নির্বাচনের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ইউজিসি নাছিরকে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কার্যক্রম সুষ্ঠু করার নির্দেশ দেয়।

ইউজিসির সাবেক দুই সদস্য অধ্যাপক আবু তাহের ও অধ্যাপক সাজ্জাদ হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়টি কুক্ষিগত করতে সহযোগিতা করেন। মহিউদ্দিন ইউজিসির চিঠির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে হাইকোর্টে রিট করেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে চসিকের হস্তক্ষেপের বৈধতাও চ্যালেঞ্জ করেন। আদালত মহিউদ্দিনের বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমে অংশগ্রহণে বাধা না দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে রুল জারি করেন। পরবর্তীতে ২০১৬ সালে হাইকোর্ট মহিউদ্দিনের পিটিশন খারিজ করে দেন এবং দেওয়ানি আদালতে প্রতিকার চাইতে বলেন।

তবে, হাইকোর্টের রায়ে পর্যবেক্ষণ করা হয় যে, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন অধ্যাদেশ, ১৯৮২ এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৯২ অনুযায়ী সিটি করপোরেশন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। এই মামলার সময় ইউজিসি চসিককে দেয়া চিঠিটি বাতিল করে। পর্যবেক্ষণের বিরুদ্ধে চসিক রিভিউ পিটিশন দায়ের করে এবং ২০১৭ সালের মে মাসে উচ্চ আদালত রায় দেয় যে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণ কোনো পক্ষের ওপর প্রযোজ্য হবে না।

মহিউদ্দিন হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলেও শুনানিতে অনুপস্থিত থাকায় তা খারিজ হয়। এর ফলে চসিকের বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় আর কোনো আইনি বাধা রইল না। তবে মেয়রকে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান করা হয়নি। ২০১৯ সালে মহিউদ্দিনের ছেলে নওফেল শিক্ষা উপমন্ত্রী হলে তিনি নিজের প্রভাবে ট্রাস্টি বোর্ডে সদস্য নিয়োগ দেন এবং তৎকালীন মেয়র নাছিরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃত্ব ছেড়ে দিতে বাধ্য করেন। ফলে নওফেল নিজেই ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হন।

চসিকের কর্মকর্তাদের মতে, আদালতে মামলা হেরে যাওয়ার পরও মহিউদ্দিন পরিবার প্রভাব খাটিয়ে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় দখল করে নেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের ১২ সদস্যের মধ্যে নওফেল (চেয়ারম্যান), তার মা হাসিনা মহিউদ্দিন ও ভাই বোরহানুল হাসান চৌধুরী সহ তিনজনই মহিউদ্দিন পরিবারের সদস্য। এছাড়াও বোর্ডে রয়েছেন এস আলম গ্রুপের তিন সদস্য, আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, উপাচার্য অধ্যাপক অনুপম সেন, রেমন্ড আরেং, প্রকৌশলী শহীদুল আলম ও সাবেক সংসদ সদস্য সাবিহা মূসা।

চসিক কর্মকর্তাদের মতে, মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুর পর তার বড় ছেলে নওফেল প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ নেন। ২০১৯ সালে শিক্ষা উপমন্ত্রী এবং পরবর্তীতে শিক্ষামন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও তিনি ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান পদটি ছাড়েননি। উপরন্তু, বিশ্ববিদ্যালয়টিকে পারিবারিক ও রাজনৈতিক কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

নওফেলের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বের কারণে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ ও পদায়নে ইউজিসির মতামত নেয়া হতো না এবং সব সিদ্ধান্ত এককভাবে নওফেলই নিতেন। এছাড়াও, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য অধ্যাপক অনুপম সেন প্রায় ১৬ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে আছেন, যদিও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী ৭৫ বছর বয়সের পর উপাচার্য থাকার সুযোগ নেই। তিনি একইসঙ্গে ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে আসীন রয়েছেন।

ইউজিসির একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানিয়েছেন যে, নওফেল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পরও ট্রাস্টি চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ না করায় স্বার্থের সংঘাত তৈরি হয়েছে। একই ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান এবং প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রধান ছিলেন, যা জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

একই ঘটনা ঘটেছে উপাচার্য এবং ট্রাস্টি সদস্য অনুপম সেনের ক্ষেত্রেও। তিনি রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানটিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নওফেলের পরিবার আত্মগোপনে চলে গেছে বলে জানা গেছে। নওফেল বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন বলে খবর পাওয়া গেছে।

এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ড. অনুপম সেন মাঝেমধ্যে ক্যাম্পাসে আসছেন। তার পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ আন্দোলন করছে, অন্যদিকে আরেকটি অংশ তাকে উপাচার্য পদে বহাল রাখার দাবিতে সোচ্চার হয়েছে।

প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী শেখ মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম জানান, প্রতিষ্ঠানটি তাদের, কিন্তু এটি ছিনতাই হয়ে গেছে। এখন তারা এটি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছেন এবং ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয়ে কিছু কাগজপত্র পাঠিয়েছেন। তিনি আশা করছেন যে তারা শীঘ্রই একটি ইতিবাচক ফলাফল পাবেন।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম ভেঙে ৮৫ বছর বয়সেও অনুপম সেনের ভিসি পদে থাকা নিয়ে তিনি বলেন, এখন আমাদের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে চসিকের এই সম্পত্তি ফিরে পাওয়া। এটা ফিরে আসার পর সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। তখন সবকিছুর সংস্কার করা হবে।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র এম মঞ্জুর আলম জানিয়েছেন, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় মূলত চসিকের সম্পত্তি ছিল, কিন্তু একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এটি দখল করা হয়েছে। তিনি বর্তমান সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষকে বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির মালিকানা ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানিয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d