চট্টগ্রামরাজনীতি

‘আন্দোলন করো মজা বুঝবে’, নগরের ২১ পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) ২১ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন থেকে গ্রেপ্তার করে নির্যাতনের অভিযোগে মামলার হয়েছে আদালতে। ২১ কর্মকর্তার মধ্যে সিএমপির দক্ষিণ জোনের উপ-কমিশনার, কোতোয়ালী জোনের সহকারী কমিশনার, কোতোয়ালী-বাকলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, কোতোয়ালী ট্রাফিক পরিদর্শক ও দুই থানার কয়েকজন উপ-পরিদর্শক ও কনস্টেবল।

বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতের হাকিম মো. জাকির হোসেনের আদালতে মামলাটি করেন নাজমুল হোসেন নামে এক শিক্ষার্থীর বড় ভাই মো. নজরুল ইসলাম। আদালত মামলাটি সিআইডির পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তা দ্বারা তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।

নাজমুল হোসেন সরকারি সিটি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ৪র্থ বর্ষের ছাত্র। তিনি লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর থানার চরবংশী এলাকার মোস্তফা বেপারীর ছেলে।

অভিযুক্তরা হলেন, নগর পুলিশের দক্ষিণ জোনের উপ-উপ-কমিশনার মোস্তাফিজুর রহমান, কোতোয়ালী জোনের সহকারী কমিশনার অতনু চক্রবর্তী, কোতোয়ালী থানার সাবেক ওসি এস.এম ওবায়েদুল হক, বাকলিয়া থানার সাবেক ওসি আফতাব উদ্দিন, কোতোয়ালী থানার পেট্রোল ইন্সপেক্টর (ট্রাফিক) মো. মিজানুর রহমান, তার মুন্সি কনস্টেবল শাহজাহান, এসআই মো. মেহেদী হাসান, রুবেল মজুমদার, রণেশ বড়ুয়া, গৌতম, কনস্টেবল কামাল, বাকলিয়া থানার এসআই আবদুস সালাম, মো. মিজান এবং ওসির দেহরক্ষী কনস্টেবল মো. ইলিয়াছসহ অজ্ঞাতনামা ৭ থেকে ৮ জন পুলিশ সদস্য।

বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বাদীর আইনজীবী স্বরুপ কান্তি নাথ। তিনি বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে গ্রেপ্তার করে কলেজছাত্র নাজমুল হোসেনকে থানায় নিয়ে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও নির্যাতন করা হয়। এছাড়া তাকে শিবির ট্যাগ দিয়ে মামলার আসামিও করা হয়। এসব অভিযোগে নগর পুলিশের এক ডিসি, এসি ও দুই ওসিসহ ১৮ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ৭ থেকে ৮ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে হেফাজতে নির্যাতনের আইনে মামলা করেছেন ভুক্তভোগীর বড় ভাই।

অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, গত ১৮ জুলাই সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বন্ধুদের সাথে নাজমুল হোসেন বাকলিয়া থানার নতুন ব্রিজ এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেয়। পরে পুলিশ ছাত্রদের ওপর অতর্কিতভাবে লাঠিচার্জ, টিয়ারশেল নিক্ষেপ এবং রাবার রবুলেট ছোঁড়ে। এসময় ঘটনাস্থল থেকে সুস্থ অবস্থায় নাজমুলকে আটক করে শারিরীক আঘাত করতে করতে পুলিশ বক্সে নিয়ে যায়।

এরপর পুলিশ সদস্যরা লোহার স্টিক, বক্সে থাকা স্ট্যাম্প দিয়ে ভিকটিমকে বেধড়কভাবে সারা শরীরে শিবির বলে পেটাতে থাকে। পরে নাজমুলকে পুলিশের একটি গাড়িতে করে প্রথমে চান্দগাঁও এবং আধঘণ্টা পর কোতোয়ালী থানায় নেওয়া হয়। গাড়ি থেকে নামানোর সাথে সাথে তিনজন এসআই ও একজন কনস্টেবল ‘শিবির আনা হয়েছে’ এবং ‘আন্দোলন করো মজা বুঝবে’ বলে উল্লাস করে এলোপাথাড়ি কিল-ঘুষি মারতে থাকে।

পরে থানার দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষে নিয়ে ‘মজা কি এখনই বুঝবে’ বলে উল্লাস করে নাজমুলের দুই হাত উপরে তুলে দেওয়ালমুখী করে দাঁড় করিয়ে কাঠের স্ট্যাম্প এবং পুলিশের ব্যবহৃত লোহার লাঠি দিয়ে পিঠ, কোমর ও দুই পায়ের উরুতে বেদম মারধর করে। ওইসময় কোতোয়ালী জোনের এসি অতনু চক্রবর্তী এবং থানার সাবেক ওসি ওবায়েদুল হক ব্যবহৃত মোবাইল ফোন নিয়ে চেক করতে থাকে। ওসি মোবাইল ফোনে কিছু না পেয়ে নাজমুলকে শিবির করে কিনা জিজ্ঞাসা করে।

তিনি না সূচক জবাব দিলে বুকে লাথি মেরে ফ্লোরে ফেলে দুটি কাঠের স্ট্যাম্প দিয়ে নাজমুলের দুই হাতের দুই বাহুর উপর রেখে ওই স্ট্যাম্পের উপর দুই জন করে দুই পাশে দাঁড়ায়। এসময় এসি ও ওসি তাকে শিবিরকর্মী বলে স্বীকার করে নিতে জোর করে। একপর্যায়ে ওই কলেজছাত্র জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এরপর তাকে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করেন। কিন্তু মেডিকেলে না নিয়ে তাকে আবারও কোতোয়ালী থানায় নেওয়া হয়। ওইদিন বিকেলে বাকলিয়া থানার টহল পুলিশ গিয়ে তাকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়।

এদিকে, নাজমুলের বড় ভাই নজরুল খবর পেয়ে বাকলিয়া থানায় যায়। এসমিয় ওসির বডিগার্ড কনস্টেবল মো. ইলিয়াছ তাকে বাকলিয়া থানার দ্বিতীয় তলায় দেখে থানায় কেন ঘুরাঘুরি করতেছে জানতে চায়। তখন সে ছোট ভাইয়ের খোঁজে এসেছে বলায় ওই কনস্টেবল উত্তেজিত হয়ে চিৎকার ও চেঁচামেচি করতে থাকে এবং বলে, ‘এই শালা (ভিকটিম) একটা শিবির, শালা আন্দোলনে যোগ দিছে। ওকে মেডিকেলে নেওয়ার আগে এইখানেই গুলি করে মেরে ফেলব।’ সাথে সাথেই সে দৌড়ে থানার হাজত খানায় গিয়ে শটগান ভিকটিমের দিকে তাক করে গুলি করে মেরে ফেলার ভয় দেখায়।

রাত ১১টার দিকে কলেজছাত্র নাজমুলের অবস্থার অবনতি হলে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতালে নেওয়া হয় এবং ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসা করানো হয়। পরে ১৯ জুলাই চিকিৎসাধীন নাজমুলকে ৮ নম্বর আসামি করে বাকলিয়া থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। যে মামলায় ১৪ দিন কারাগারে থাকার পর আদালত তাকে জামিনে মুক্তি দেয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d