জাতীয়

একটার পর একটা মেগাপ্রজেক্টের উদ্বোধন— ‘বিস্ময়ে তাই জাগে’

বিস্ময়ের শুরু সেই কবে হয়েছে তা যেন দিনে দিনে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে নতুন নতুন বিস্ময়ের ঝলকানিতে। বহুবছর আগে শুরু করা কাজগুলো একে একে শেষ হচ্ছে, আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হচ্ছে আর অস্ফুটে বেরিয়ে আসছে- সত্যি! এটা সম্ভব হলো তবে। হ্যাঁ এখন অসম্ভবগুলো সম্ভব হয়ে ধরা দিতে শুরু করেছে। বলছিলাম মেগা প্রজেক্টগুলোর কথা।

সরকার তাদের নির্বাচনী ওয়াদা পূরণের বিষয়টি মাথায় রেখে মেগা প্রকল্পগুলো চালু করা শুরু করেছে। এরইমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেছেন দেশের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। ৭ অক্টোবর উদ্বোধন হলো বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল। এই অক্টোবর মাসেই যোগাযোগ অবকাঠামোসহ নানা খাতের আরও কয়েকটি মেগা প্রকল্প উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছে, যা ধাপে ধাপে খুলে দেবে সরকার।

উদ্বোধনের তালিকায় মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে আছে মেট্রোরেল লাইন-৬, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প, খুলনা-মোংলা রেল প্রকল্প, কক্সবাজার রেল সংযোগ প্রকল্প, আখাউড়া-আগরতলা আন্তদেশীয় রেল সংযোগ প্রকল্প। অথচ এই প্রকল্পগুলো সম্পন্ন করা নিয়ে নেতিবাচক আলাপের শেষ ছিলো না। বিরোধীদল বারবার চেষ্টা করেছে এসব প্রকল্প নিয়ে বিরোধী কথা বলতে। কেন মেট্রোরেল পুরোটা না শেষ করে আগারগাঁও পর্যন্ত উদ্বোধন হলো। কেন এলিভেটেড এক্সপ্রেওয়েতে উঠতে টাকা লাগবে- এরকম নানা প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। কিন্তু জনগণ তার ভালোটা ঠিকই বুঝে নিতে চায় এটাও প্রমাণ হতে শুরু করেছে।

গত ডিসেম্বরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত দপ্তর সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেছিলেন, মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ আগামী বছর (২০২৩) শেষ হওয়ার কথা থাকলেও শেখ হাসিনা (প্রধানমন্ত্রী) সেই পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার ভরসা পাচ্ছেন না। এ কারণে উন্নয়ন দেখাতে কাজ অসমাপ্ত রেখেই ঢাকঢোল পিটিয়ে জনগণের কোটি কোটি টাকা অপচয় করে তাড়াহুড়ো করে মেট্রোরেলের একাংশের উদ্বোধন করা হয়েছে।’ এইধরনের মিথ্যাচারের শক্ত জবাব হিসেবে এই মাসেই শুরু হতে যাচ্ছে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেলের চলাচল।

এই অক্টোবরে উদ্বোধন হতে যাচ্ছে মেট্রোরেলের আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশ। গত ৭ জুলাই আগারগাঁও-মতিঝিল অংশে ট্রেনের পরীক্ষামূলক যাত্রার উদ্বোধন করে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, আগামী অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মেট্রোরেলের আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশের উদ্বোধন করবেন।

দেশের মানুষের বিস্ময়ে আরেকটি পালক যুক্ত হতে চলেছে কর্ণফুলী টানেল এর মাধ্যমে। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণ হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। অক্টোবর মাসের ২৮ তারিখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ টানেলের উদ্বোধন করবেন। টানেলটি চট্টগ্রাম বন্দরকে সরাসরি আনোয়ারা উপজেলার সঙ্গে সংযুক্ত করা ছাড়াও সরাসরি কক্সবাজারকে চট্টগ্রামের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। ৩৫ ফুট প্রস্থ এবং ১৬ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট দুটি টিউব ১১ মিটার ব্যবধানে তৈরি করা হয়েছে, যাতে ভারী যানবাহন সহজেই টানেলের মধ্য দিয়ে চলতে পারে। টানেলের দৈর্ঘ্য ৩.৪০ কিলোমিটার। যার সঙ্গে ৫.৩৫ কিলোমিটারের অ্যাপ্রোচ রোডের পাশাপাশি ৭৪০ মিটারের একটি সেতু রয়েছে, যা মূল শহর, বন্দর এবং নদীর পশ্চিম দিককে এর পূর্ব দিকের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে।

এই সপ্তাহেই উদ্বোধন হলো রূপপুরে প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। ১৯৬১ সালে পাবনা জেলার ঈশ্বরদীর রূপপুরে প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সেই সময়কার পাকিস্তান সরকার। ১৯৬৮ সাল নাগাদ জমি অধিগ্রহণসহ বেশ কিছু কাজ আংশিক সম্পন্নও হয়। কিন্তু তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তাল ঢেউ শুরু হলে প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত বাতিল করে তৎকালীন সরকার। স্বাধীনতার পরে ফের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণের উদ্যোগ নেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার। এ সপ্তাহে সেই স্বপ্ন পূরণ হলো। পাবনার রূপপুরে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে রাশিয়া থেকে ‘ফ্রেশ নিউক্লিয়ার ফুয়েল’ বা ইউরেনিয়াম হস্তান্তর করার দিনটিকে ‘অত্যন্ত গর্বের ও আনন্দের দিন’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ সরকারের নিরলস প্রচেষ্টায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আজ সফল পরিণতি পেলো বলে তিনি মন্তব্য করেন। ৫ অক্টোবর ইউরেনিয়াম হস্তান্তর অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।

এরই মধ্যে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের একাংশ উদ্বোধন হয়েছে। অগ্রগতির তথ্য বলছে, পুরো প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে ৮৩ শতাংশ। এর মধ্যে মাওয়া-ভাঙ্গা অংশের অগ্রগতি হয়েছে ৯৮ শতাংশ। ঢাকা-মাওয়া অংশের অগ্রগতি হয়েছে ৮১ শতাংশ। এদিকে ভাঙ্গা-যশোর অংশের কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৭৮ শতাংশ। ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার রেললাইন বসানো এবং স্টেশন ও অন্য অবকাঠামো নির্মাণের জন্য আলাদা প্রকল্প নেয় রেলওয়ে ২০১৬ সালের জুনে। জিটুজি পদ্ধতিতে এ প্রকল্পে অর্থায়ন করছে চীন। পদ্মা সেতু রেল সংযোগের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ আছে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত।

আরেকটি বড় বিস্ময় ঢাকা-কক্সবাজার রুটের ট্রেন। এরই মধ্যে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে। পর্যটননগরী কক্সবাজারে নির্মাণ করা হয়েছে ঝিনুকের আদলে দৃষ্টিনন্দন আইকনিক রেলস্টেশন। সেপ্টেম্বরে এ রেল সংযোগের উদ্বোধনের কথা থাকলেও কালুরঘাট সেতু সংস্কার ও বান্দরবানের পাহাড়ি ঢলে রেলপথ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এ প্রকল্পের উদ্বোধন পিছিয়েছে। রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন জানিয়েছেন, দ্রুততম সময়ে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত অংশ ঠিক করা হচ্ছে। এরপর খুব দ্রুত সময়েই উদ্বোধনের তারিখ জানানো হবে।

একটি দেশের মানুষের সামনে তার এগিয়ে চলার জন্য জীবনের উন্নয়নের জন্য একের পর এক এতোগুলো বিস্ময় সত্যিতে পরিণত হওয়ার পরে আর কোন দ্বিধা থাকে না। একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য দরকার সরকারের ধারবাহিকতা। এটা এর আগেও প্রমাণিত। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী সরকার আসার পরে উন্নয়নের যে পরিকল্পনা করেছিলো পরবর্তীতে ২০০১ এ সরকার পরিবর্তন হওয়ার পরে তার কোনটিই এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। ২০০৯ থেকে এসে আবারও সেই জায়গাগুলোসহ আরও নতুন নতুন প্রকল্প হাতে নেয় আওয়ামী সরকার। এবং সেসময় থেকে আজ পর্যন্ত টানা সরকার পরিচালনার দায়িত্বে থাকার কারণেই পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে। এটা এখন জনগণ বুঝতে শুরু করেছে। ফলে বিরোধীদল থেকে কেবল বিরোধিতা করার জন্য নেতিবাচক কথা ছড়িয়ে এখন মানুষের বিস্ময় কাটানো যাবে বলে মনে হয় না।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d