জাতীয়

কোরবানির চামড়ার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করবে সরকার

এবার কোরবানির পশুর চামড়া সংরক্ষণে সারাদেশের এতিমখানাগুলোতে বিনামূল্যে লবণ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। চামড়ার ন্যায্যদাম নিশ্চিত করতে বাসাবাড়ি থেকে সংগ্রহের পরই তা যেন পানির দরে বিক্রি না করে বরং বেশ কিছুদিনের জন্য সংরক্ষণ করা হয়- সেজন্য এই উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে সরকার। এতিমখানার পাশাপাশি যেসব প্রতিষ্ঠান সমাজসেবা ও শিক্ষামূলক কাজ সম্প্রসারণে কাজ এগিয়ে নিতে বিনামূল্যের চামড়া সংগ্রহ করে, তাদেরকে এই লবণ দেওয়া হবে। এছাড়া কোরবানির সময় সাধারণত মসজিদ, মাদ্রাসা, দাতব্য প্রতিষ্ঠান ও লিল্লাহ বোর্ডিংগুলোর পক্ষ থেকে চামড়া সংগ্রহ করা হয়। কোরবানি দাতারা বিনামূল্যে এই চামড়া দান করে থাকেন। এ বছর ১ কোটি ২৫ লাখ গবাদিপশু কোরবানির জন্য প্রস্তুত রয়েছে বলে জানিয়েছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। আশা করা হচ্ছে, কোরবানি থেকে এবার প্রায় সোয়া কোটি চামড়া সংগ্রহ করা হবে। আগামী সপ্তাহে কাঁচা চামড়ার দাম নির্ধারণ করবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কোরবানির চামড়া ব্যবস্থাপনায় তদারকির লক্ষ্যে সরকারি উদ্যোগে একটি যৌথ মনিটরিং টিম গঠন করা হবে।

অভিযোগ রয়েছে, কারসাজি করে কোরবানির বিনামূল্যের চামড়া অনেকটা পানির দরেই এতিমখানা, মাদ্রাসা এবং মসজিদ থেকে কিনে থাকেন চামড়া সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। বিশেষ করে ট্যানারি মালিক, ঢাকার পোস্তা, চট্টগ্রাম এবং নাটোরের আড়তদার ব্যবসায়ী ও স্থানীয় ফড়িয়াদের কারসাজির কারণে চামড়ার ন্যায্যদাম কার্যকর হচ্ছে না। শুধু তাই নয়, মাংস ব্যবসায়ীরা বলছেন, চামড়া সঠিক দাম পাওয়া গেলে গরুর মাংসের দাম কমানো সম্ভব। তাদের অভিযোগ, গত বিশ বছরে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়লেও শুধু এ দেশে কাঁচা চামড়ার দাম কমেছে। অথচ এই সময়ে চামড়াজাত পণ্যের দাম বেড়েছে ২০ গুণের বেশি। দুই দশক পূর্বে ২০০০-০৪ সালে প্রতিপিস গরুর চামড়া মানভেদে তিন থেকে ছয় হাজার টাকায় বিক্রি হলেও এখন সেই চামড়া বিক্রি হয় মাত্র ৬০০-১২০০ টাকায়। এ প্রসঙ্গে ঢাকার আলোচিত মাংস ব্যবসায়ী খলিলুর রহমান জানান, গরুর মাংসের দাম কমাতে হলে আগে চামড়ার ন্যায্যদাম নিশ্চিত করতে হবে। চামড়ার ভালো দাম না পাওয়ায় গরুর মাংসের দাম বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, আশা করছি, এবার কোরবানির সময় সব ধরনের পশুর চামড়ার সঠিক দাম কার্যকর হবে। বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম বলেন, কোরবানির চামড়ার সঠিক দাম পেতে কঠোর মনিটরিং প্রয়োজন। এ খাতের অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে হবে। অন্যদিকে বাংলাদেশ ট্যানারি অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) থেকে দাবি করা হয়েছে, গতবছর দেশে সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া বেচাকেনা হয়েছে। এ বছরও নির্ধারিত দামে চামড়া কিনবেন ট্যানারি মালিকরা।

জানা গেছে, আগামী সপ্তাহ নাগাদ কাঁচা চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হবে। ইতোমধ্যে চামড়ার দাম নির্ধারণে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) মাধ্যমে আন্তর্জাতিক এবং দেশী মূল্য বিবেচনায় নিয়ে একটি যৌক্তিক দাম নির্ধারণ করতে চায় সরকার। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, প্রতিবছরের ধারাবাহিকতায় এ বছর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। এ বিষয়ে কাজ শুরু হয়েছে। চামড়া যাতে পানির দরে ব্যবসায়ীরা কিনতে না পারেন সে বিষয়ে সতর্ক থাকবে সরকার। শুধু তাই নয়, স্থানীয়ভাবে চামড়া সংগ্রহ এবং পর্যাপ্ত লবণ দিয়ে চামড়া সংরক্ষণের জন্য কৌশলগত স্থানে অস্থায়ী সংরক্ষণাগার নির্মাণ করতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশনা দেওয়া হবে। এছাড়া কোরবানির চামড়া সঠিকভাবে ছাড়ানো, মানসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করা, কসাই ও মসজিদের ইমামদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। দেশের এতিমখানায় যেহেতু সবচেয়ে বেশি চামড়া দান করা হয়, সেজন্য এসব প্রতিষ্ঠানে বিনামূল্যে লবণ দেওয়ার প্রস্তাব করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়। শিল্প মন্ত্রণালয় মনে করে, এটি বাস্তবায়ন করা গেলে স্থানীয়ভাবে চামড়া নষ্টের হাত রক্ষা পাবে এবং চামড়ার সঠিক দাম নিশ্চিত হবে। এদিকে, কোরবানির ঈদ সামনে রেখে চামড়া শিল্পখাতের উন্নয়নে সুপারিশ প্রদান ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের লক্ষ্যে গঠিত টাস্কফোর্সের ৭ম সভা রবিবার শিল্প মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনের সভাপতিত্বে ওই সভায় অংশগ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু, চামড়া শিল্পনগরী, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা। কোরবানি ঈদ সামনে রেখে চামড়ার ন্যায্যদাম নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সভায় শিল্প মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বেশকিছু প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, স্থানীয়ভাবে চামড়া সংরক্ষণে জেলা, উপজেলা, ও ইউনিয়ন পর্যায়ে পর্যাপ্ত লবণ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া এতিমখানাগুলোতে কোরবানির সময় বিনামূল্যে লবণ সরবরাহ করা যেতে পারে। সভা সূত্র জানিয়েছে, এবার চাহিদা অনুযায়ী লবণের সরবরাহ নিশ্চিত করা, সরকার কর্তৃক নির্ধারিত মূল্যে চামড়া কেনাবেচা, পরিবহন ও সংরক্ষণ প্রভৃতি কার্যক্রম বাস্তবায়নে বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে শিল্প মন্ত্রণালয় এবং জননিরাপত্তা বিভাগের সমন্বয়ে একটি যৌথ মনিটরিং টিম গঠন করা হবে।

এছাড়া পশুর চামড়া যাতে পাচার না হয় সে বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ করা হবে। চামড়া সংগ্রহ ও পরিবহন কার্যক্রমে কোনো প্রকার চাঁদাবাজি বিশৃঙ্খলা বা বাধার সৃষ্টি না হয় সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন করা হবে। চামড়া শিল্পনগরীর বর্জ্য পরিশোধনে সিইটিপির পরিশোধন ক্ষমতার মধ্যে সীমিত রাখার লক্ষ্যে কোরবানির পরবর্তী এক মাসের মধ্যে ঢাকার বাইরে থেকে যাতে কোরবানির পশুর চামড়া ঢাকার মধ্যে প্রবেশ করতে না পারে সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কোরবানির সময় সাভার চামড়া শিল্পনগরীতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করবে সরকার। সভায় শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন বলেন, চামড়া শিল্পখাতের উন্নয়নে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি করণীয় নির্ধারণ করা হয়েছে। আসন্ন কোরবানির ঈদ উপলক্ষে স্বল্প মেয়াদি ও চামড়া শিল্পখাতের সার্বিক উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি করণীয় নির্ধারণ করা হয়েছে। বিসিক ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নীতিগত সহযোগিতাসহ এসব করণীয় বাস্তবায়নে সব ধরনের সহায়তা প্রদান করা হবে। তিনি বলেন, চামড়া শিল্পখাতে সংরক্ষণ সুবিধা বাড়াতে হবে যাতে চামড়া নষ্ট না হয়। চামড়া ব্যবসায়ী/ পাইকারগণ যাতে পুঁজির সমস্যায় না পড়েন ও সহজ শর্তে ঋণ পান, সে বিষয়েও পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d