টাকার অভাবে বন্ধুর বই পড়েই সহকারী জজ হলেন নুর
নিজের চেষ্টা আর অদম্য ইচ্ছা যে একজনকে সফল করতে পারে তার আরও একটি উদাহরণ আসাদুজ্জামান নুর। সদ্য প্রকাশিত ১৬তম বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের (বিজেএসসি) নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফলে সহকারী জজ পদে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। যদিও একসময় পড়ার বই কেনার মতো টাকা তার কাছে ছিল না। বন্ধুর কাছ থেকে বই নিয়ে পড়াশোনা করে তিনি এ ফলাফল করেন। করোনায় দীর্ঘ সময় অর্থ সংকটের কারণে অন্যের দোকানে কর্মচারী হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি।
আসাদুজ্জামান নুর উত্তরের জেলা পঞ্চগড় সদরের ব্যারিস্টার বাজার এলাকার মৃত নুর বাদশার ছেলে। তিনি ২০১৭-১৮ বর্ষের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও ভূমি ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র ছিলেন।
২০১৪ সালে পঞ্চগড় বিপি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি, ২০১৬ সালে পঞ্চগড় মকবুলার রহমান সরকারি কলেজ থেকে জিপিএ ৪ দশমিক ৩৩ পেয়ে এইচএসসি পাশ করে চেষ্টা করেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার। কিন্তু সে বছর ভর্তির সুযোগ না পেয়ে ইংরেজি বিষয়ে স্নাতকে ভর্তি হন একই কলেজে। ২০১৭ সালে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন ও ভূমি ব্যবস্থাপনা বিভাগে ভর্তির সুযোগ পেয়েই শুরু করেন কঠোর পড়াশোনা।
২০১২ সালে বাবার মৃত্যুর পর আর্থিক সংকটে পড়েন নুর। তখন তিনি নবম শ্রেণির ছাত্র। মাত্র ৬ শতক জমির ওপর ভিটেমাটি ছিল একমাত্র সহায় সম্বল। তবে হাল না ছেড়ে লেগে যান কঠিন জীবন যুদ্ধে। মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রম ও অনুপ্রেরণায় ১৬তম বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের (বিজেএসসি) নিয়োগ পরীক্ষায় ৪০তম হন। বই কেনার টাকা না থাকায় বন্ধুর কাছ থেকে বই নিয়ে পড়ে প্রথমবারের পরীক্ষাতেই নুর পৌঁছে যান এ সাফল্যের শিখরে। সুপারিপ্রাপ্ত হন সহকারী জজ পদে। এ পেশাতেই একজন ন্যায় বিচারক হতে চান তিনি।
করোনা কাটলেও কাটছিল না অনিশ্চয়তা। অনেকের কাছে সহযোগিতা চাইলেও মিলেনি সাড়া। তবে প্রিয়জনদের কাছ থেকে পেয়েছেন সহযোগিতা। বাবা মারা যাওয়ায় মা তাকে সাহস যোগাতেন। মায়ের জন্যই এ সফলতা এসেছে বলে জানান নুর।
আসাদুজ্জামান নুর বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার প্রথম দুই বছর ‘সেন্টার ফর জাকাত ম্যানেজমেন্ট’ এর সহযোগিতায় পার করেছি। করোনা প্রকোপের পর আর্থিক সংকটে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। ঠিক ওই মুহূর্তে ‘পে ইট ফরওয়ার্ড বাংলাদেশ’ গ্রুপের খোঁজ পাই। সংস্থাটি আমাকে আর্থিক নিরসনের লক্ষ্যে পৌঁছতে সহযোগিতা করেছে। এ কারণে পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারি। সংস্থাটির প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো।
পরবর্তীতে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের (বিজেএসসি)-তে অংশ নিতে বন্ধু হোসনে মোবারক সাগর ও নোসাইব মোহাম্মদ নাজ্জাসির বই নিয়ে পড়াশোনা শুরু করি। বিজেএসসির প্রিলি হতে লিখিত পরীক্ষার পুরোটা সময় তাদের বই পড়েছি। কারণ আমার বই কেনার কোনো সামর্থ্য ছিল না। জুডিশিয়ারীর দিক নির্দেশনায় আমাকে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছেন সাকিব আহমেদ ইমন ভাই। তিনি ছিলেন ১৫তম বিজেএসসি পরীক্ষায় সহকারী জজ হিসেবে সুপারিশ প্রাপ্ত। তাছাড়া ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকরাও আমাকে সব ধরনের সহযোগিতা করে অনুপ্রাণিত করেছেন।
নুর জানান, আগে থেকে বিচারক হওয়ার স্বপ্ন না থাকলেও পরবর্তীতে স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। সে অনুযায়ী প্রস্তুতিও নিতে থাকি। তবে আমার বাবা চাইতেন আমাকে আইনে পড়াবেন। আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহর রহমতে ১৬তম বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের (বিজেএসসি) নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সহকারী জজ পদে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছি।
ন্যায় বিচারক হতে চাই। কেননা ন্যায় বিচারকের সম্মান দুনিয়া ও আখেরাতেও। কেয়ামতের দিন আল্লাহ যেই সাত শ্রেণির মানুষকে তার আরশের ছায়ায় আশ্রয় দিবেন, তাদের মধ্যে প্রথম হলো ন্যায় বিচারক। তাই সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন যেন আমার দ্বারা অন্যায়ভাবে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। সবাই উপকৃত হন। বিশেষ করে আমার এ অর্জনে সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন আমার বাবা। গর্ব করে বলতেন আমার ছেলে বিচারক হয়েছে। কিন্তু তিনি আজ নেই। বাবার জন্য দোয়া চাই, আল্লাহ যেন বাবাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করেন।