রাজনীতি

তিন নীতির ভিত্তিতে আসছে নতুন ইসলামী জোট

গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর দেশের রাজনীতিতে নতুন বাতাস বইতে শুরু করেছে। নতুন করে শুরু হয়েছে নানা সমীকরণ আর রাজনীতির নতুন মেরুকরণ। এর অংশ হিসেবে নতুন জোট গঠন করতে যাচ্ছে দেশের ইসলামী আদর্শের রাজনৈতিক দলগুলো।

জানা গেছে, তিনটি নীতিতে এই জোট গঠনের পক্রিয়া রয়েছে শেষ পর্যায়ে।

সম্প্রতি দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় জাতীয় দৈনিকে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের শীর্ষ নেতা মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম সাক্ষাতকার দিয়েছেন।

সাক্ষাতকারে ফয়জুল করীম বলেন, ইসলাম, দেশ ও মানবতা- এই ৩ মূলনীতি ও আদর্শকে সামনে রেখে যারাই জোট করতে আগ্রহী তাদের সঙ্গে ইসলামী আন্দোলন ঐক্যবদ্ধ হবে। শুধু ভোটের উদ্দেশ্যে জোট হলে সেটি কার্যকরী জোট হবে না।

অতীতেও শুধু নির্বাচনকেন্দ্রিক জোট হয়েছে, যা পরবর্তী সময়ে ভেঙেও গেছে। এখানে শুধু জামায়াতসহ ইসলামি দল নয়, ডান-বাম এবং মুসলিম-হিন্দুসহ যারাই- এই তিন নীতিকে ভিত্তি করে জোট করতে এগিয়ে আসবে তাদের সঙ্গে আমরা জোট করতে আগ্রহী।

জোটের ব্যাপারে বিভিন্ন দলের সঙ্গে আলোচনা চলছে, কোন কোন দলকে দেখা যেতে পারে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এটা এই মুহূর্তে বলা খুবই কঠিন। বিভিন্ন দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে। যারা দেশের কল্যাণ চায়, মুক্তি চায়, শান্তি চায়, দেশের মানুষের স্বাধীনতা ও অধিকার চায় সবাইকে জোটে দেখা যেতে পারে।

তিনি জানান, মতপাথর্ক্য নেই এমন কোনো দল বা গোষ্ঠী পৃথিবীতে পাওয়া অসম্ভব। ইসলামি দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্যগুলো এখনো দূর হয়নি। আশা করি, আন্তরিকতার সঙ্গে সবাই মিলে উদ্যোগ নিলে এসব মতানৈক্য দূর করা সম্ভব।

ফয়জুল করীম বলেন, আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়েছি পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনব্যবস্থা চালু করতে। অর্থাৎ সংখ্যানুপাতিক হারে নির্বাচন। এই পদ্ধতিতে দলীয় কোনো প্রার্থী থাকবে না, শুধু মার্কা থাকবে।

দলীয় মার্কায় জনগণ ভোট দেবে, যে দল যত পারসেন্ট (শতাংশ) ভোট পাবে সেই অনুযায়ী তারা আসন পাবেন। পিআর পদ্ধতি সব দলের জন্যই সহজ ও ভালো পদ্ধতি। এতে দুর্নীতি ও কালোটাকার ছড়াছড়ি এবং পেশিশক্তির ব্যবহার কমে যাবে ৮০ শতাংশ। জোট থেকে যে আসনে যে প্রার্থী যোগ্য ও জয়লাভের সম্ভাবনা আছে, তাকেই সেই আসনে প্রার্থী করা হবে।

আমাদের মূল উদ্দেশ্য ক্ষমতা নয়, নীতি ও আদর্শ বাস্তবায়ন। ইসলামের নীতি ও আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য যাকে যেখানে সম্ভাবনাময় মনে করব তাকে সেখানে মনোনয়ন দেওয়া হবে। এখানে আসন বণ্টন নিয়ে জটিলতা আছে বলে মনে করছি না।

যদি ইসলামী জোট আগামীতে ক্ষমতায় আসে, তাহলে রাষ্ট্র কীভাবে পরিচালিত হবে এমন প্রশ্নের উত্তরে ফয়জুল করীম বলেন, ইসলামী নীতিমালা অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালিত হবে।

এই নীতিমালায় বলা আছে, কীভাবে সরকার পরিচালিত হবে, তার দায়িত্ব কী হবে, কার কতটুকু দায়িত্ব ও অধিকার রয়েছে।

কিন্তু অনেকেই মনে করে ইসলামী দল ক্ষমতায় এলে বিধর্মীদের ক্ষতি হবে, নারীদের চাকরি করা বন্ধ হয়ে যাবে— ইসলামফোবিয়া জনগণ সমাজে এমন অনেক কিছু ঢুকিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এগুলোর সঙ্গে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ মানুষের অধিকার বাস্তবায়নের জন্যই ইসলামের সৃষ্টি হয়েছে।

আমি মনে করি, ‘আগামী দিনে ইসলামী দল ক্ষমতায় এলে সংখ্যালঘুদের অধিকার আরও বেশি বাস্তবায়িত হবে, তারা বেশি সুখে-শান্তিতে থাকবেন। তাদের ধর্মীয় অধিকার, ব্যবসা-বাণিজ্য অধিকার, অর্থনীতি-শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ কোনো জায়গাতেই হস্তক্ষেপ হবে না। এখন ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করতে বেগ পেতে হলেও তখন স্বাভাবিকভাবে সবকিছু করতে পারবেন। নারীরা তাদের ন্যায্য অধিকার ও সম্মান পাবেন। সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করব সর্বপ্রথম। কারণ ন্যায়বিচারের মাধ্যমে ইসলাম গোটা বিশ্বে ছড়িয়েছে এবং স্থায়িত্ব পেয়েছে।’

সম্প্রতি জাতীয় নাগরিক কমিটি গঠন নিয়ে তিনি বলেন, দেশের কল্যাণের জন্য যেকোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী দল গঠন করতে পারে। এটা সবার জন্য উন্মুক্ত। প্রত্যেকেই তাদের চিন্তা-ভাবনা থেকে নতুন দল গঠন করেন। তারা তাদের নীতি ও আদর্শ মেনে যদি দেশের জন্য ভালো কিছু করতে পারেন, তাহলে তাদের আমরা স্বাগত জানাই।

এদিকে অভিন্ন উদ্দেশ্যে বৃহত্তর জোট গঠনের মাধ্যমে দেশের রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান গড়ে তুলতে পরস্পরের সঙ্গে বৈঠক শুরু করেছে দেশের ইসলামী দলগুলো। মতভেদ কাটিয়ে নিজেদের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে ইতিবাচক প্রাথমিক আলোচনা চলছে বলে জানিয়েছেন দলগুলোর নেতারা।

ইসলামী ও সমমনা কয়েকটি দলের একাধিক নেতা জানান, গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী শাসনে বেশির ভাগ ইসলামী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।

তাই ইসলামী দলগুলোকে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসার তাগিদ অনুভব করছেন শীর্ষস্থানীয় নেতারা। তাদের প্রত্যাশা, গণ-অভ্যুত্থানের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ইসলামী দলগুলো বৃহৎ জোট গঠন করলে রাজনীতিতে নতুন একটি শক্তির আবির্ভাব ঘটতে পারে। নিজেদের মধ্যে মতের ভিন্নতা থাকলেও ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার আলোকে রাষ্ট্র গঠনের অভিন্ন উদ্দেশ্যে তাঁরা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

‘ইসলামী জোট’ গঠনের তৎপরতায় কিছুটা এগিয়ে আছে শীর্ষস্থানীয় দুটি ইসলামী দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ।

এরই মধ্যে এ দুটি দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা সমমনা দলগুলোর বড় নেতাদের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেছেন।

খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ ও খেলাফত মজলিসের মতো পুরনো মিত্রদের সঙ্গে জোট গঠনের বিষয়ে আলোচনা করছে দল দুটি। এ ছাড়া জাকের পার্টি, নেজামে ইসলাম পার্টি ও ইনসানিয়াত বিপ্লবের মতো ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা চলছে তাদের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d