দালাল নেই, সেবা দিতে একপায়ে খাড়া সবাই!
সকাল গড়িয়ে দুপুর হতেই বাড়ছিল নারী-পুরুষের ভিড়। ফটকে নেই দালালের আড্ডা। নেই অযাচিত মানুষের ভিড়। আগে যেখানে হাতের মুঠোয় ৫০০ টাকা গুঁজে দিলেই মিলতো ‘জামাই আদর’; সেখানে শুধুই এখন সেবাপ্রার্থীর ভিড়। লাইন ভেঙে সামনে এগুতে চাইলেই হৈহুল্লোড় করে উঠছেন সেবাগ্রহীতারা। দিচ্ছেন বাধা। আনসার-পুলিশ সদস্যরাও সবার কাছে গিয়ে গিয়ে জানতে চাইছেন—কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা।
শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর বদলে যাওয়া এমন চিত্র এখন চোখে পড়ছে নগরের ডবলমুরিং থানার মনছুরাবাদে চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসে। কারো মুখে কোনো অভিযোগ নেই, সব চলছে আপন গতিতে। বৃহস্পতিবার (২৯ আগস্ট) সকাল থেকে প্রায় চারঘণ্টা অবস্থান করে দেখা যায় এসব।
‘আগে সিরিয়াল ধরলে দিন পার হয়ে যেতো’
মাস ছয়েক আগে চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিস ও ভিসা অফিসে হাতের মুঠোয় গুজে দেওয়া ৫০০ টাকার ‘ক্যারিশমায়’ পাওয়া যেতো ‘জামাই আদর’। নারী-পুরুষ কাউকে দাঁড়াতে হতো না লাইনে। পাসপোর্ট অফিসে দায়িত্ব পালন করা পুলিশ, আনসার, কর্মচারীরা মুহূর্তেই সারি ভেঙে তাঁদের পৌঁছে দিতেন একেবারে কাউন্টার পর্যন্ত।
কিন্তু এখনকার চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো। পাসপোর্ট অফিসের মূল ফটক দিয়ে ঢুকতেই ডান পাশে দেখা মিলল আবেদন জমা দিতে আসা পুরুষের লম্বা লাইন। বেলা ১২টার দিকে ৫ শতাধিক মানুষ সেখানে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো। এ সময় লাইনের আশপাশে কিংবা ফটকের সামনে দেখা পাওয়া যায়নি কোনো দালালের। কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা—তা জানতে দায়িত্বরত আনসার এবং পুলিশ সদস্যরাও এসে খোঁজ নিচ্ছিলেন।
লাইন ধরে কিছুদূর এগুতেই কথা হয় বাকলিয়ার বাসিন্দা মো. আবিরের সাথে। তার গ্রামের বাড়ি বোয়ালখালী উপজেলায়। চট্টগ্রামের অস্থায়ী ঠিকানা থেকে পাসপোর্ট বানাতে মনছুরাবাদ বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসে এসেছেন। সিভয়েস২৪’কে তিনি বলেন, ‘সকাল সাড়ে ১১টার দিকে আমার মা পাসপোর্টের আবেদন জমা দিতে এসেছেন। আমি তাঁর সঙ্গে এসেছি। এখন পর্যন্ত কোনো হয়রানির শিকার হইনি। উল্টো একজন পুলিশ সদস্য আমার মায়ের কাগজপত্র সাজিয়ে দিতে সাহায্য করেছেন। এখন পর্যন্ত টাকার বিনিময়ে লাইন এদিক-ওদিক হয়েছে বলে দেখিনি।’
বিশৃঙ্খলা দেখেছেন কিনা—জানতে চাইলে আবির বলেন, ‘কেউ বিশৃঙ্খলা করলে এখানকার মানুষ সবাই দেখলাম আওয়াজ তুলছে। আমিও একবার একটি সমস্যার কারণে ঢুকতে চেয়েছিলাম ভবনের মধ্যে কিন্তু আমাকেও ঢুকতে দেয়নি। এরকম হলেই ঠিক আছে। একটু সময় লাগলেও দালাল ছাড়া করা যাচ্ছে সব কাজ। আমি দালাল ধরে আগে ঢুকে গেলে তো আরেকজন কষ্ট পাবে।’
নগরের কাটগড় এলাকার ডেইলপাড়া থেকে আসা মো. তানিম বলেন, ‘আবেদন জমা দিতে এসেছি সকাল ১০টার দিকে। আগেও আমি একাধিকবার এসেছিলাম। কিন্তু এখন আগের তুলনায় অনেক কড়াকড়ি। সিরিয়াল ছাড়া ঢোকাই যাচ্ছে না।’
তানিমের সাথে কথা শেষ হতেই চোখ পড়ে কাউন্টার সম্বলিত ভবনের ফটকের সামনে দাঁড়ানো কালো শার্ট পড়া এক যুবকের ওপর। তিনি বিভিন্ন সেবাপ্রার্থীর তথ্য দিচ্ছিলেন এবং সারিবদ্ধভাবে ঢোকাচ্ছিলেন। তাঁর কাছে গিয়ে পরিচয় জানতে চাইলে নিজেকে আনসার সদস্য হিসেবে পরিচয় দেন।
বিপ্লব নামে ওই আনসার সদস্য ভয়ে সাদাপোশাকে ডিউটি করছেন জানিয়ে বলেন, ‘আগের চেয়েও এখন সেবা অনেক ভালোভাবে দিচ্ছি। তবে পাবলিকের ভয়ে সাদাপোশাকে ডিউটি করছি। দেশের যে অবস্থা তাতে পোশাক পড়ে দায়িত্ব পালনে নিরাপদবোধ করি না।’
ভবনের ভেতরে গিয়ে দেখা গেল, ৫ নম্বর কাউন্টারে পাসপোর্ট ডেলিভারি নিতে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন চারজন পুরুষ এবং ৬ নম্বর কাউন্টারে দুজন নারী। অন্যদিকে আবেদন জমা দিতে ১ নম্বর কাউন্টারে দাঁড়িয়েছিলেন অন্তত ২০ জন নারী এবং পাশাপাশি ৩ নম্বর কাউন্টারে ছিলেন অন্তত ৫০ জন পুরুষ। লাইনে দাঁড়ানো বেশিরভাগ যুবক বয়সী হলেও আছেন বৃদ্ধরাও।
নারীদের মধ্যে একজন ছিলেন মধ্যবয়সী। তিনি দক্ষিণ পতেঙ্গার বাসিন্দা রাবেয়া খাতুন। ওই নারী বলেন, ‘খুবই ভালোভাবেই পাসপোর্ট ডেলিভারি নিতে আসলাম। এতটা সারিবদ্ধ-সুশৃঙ্খল দেখে খুবই ভালো লাগছে। বাচ্চারা যা করে দিয়েছে, তা এক কথায় অকল্পনীয়।’
পাসপোর্ট ডেলিভারি নিতে আসা হালিশহরের বাসিন্দা মিনহাজুল ইসলাম রিয়ন বলেন, ‘আমি মাত্র ২০ মিনিট আগেই এসেছি। এসেই লাইনে দাঁড়িয়েছি। আজকে ডেলিভারির তারিখ ছিল আমার পাসপোর্টের। ডেলিভারিতে চাপ কম। এখন পর্যন্ত কেউ কিছু জিজ্ঞেস বা হয়রানি করেনি। তবে এখানে যিনি পুলিশ সদস্য আছেন, তিনি বারবার এসে কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা জানতে চেয়েছেন। বিষয়টা খুবই ভালো লেগেছে। পুরোই বদলে গেছে এই সরকারি অফিস।’
আগে কি সমস্যা দেখেছেন—জানতে চাইলে বলেন, ‘আগে সিরিয়াল ধরলে দিন পার হয়ে যেতো। দালালের মাধ্যমে সামনে নিয়ে আসতো। এই সমস্যাটি মনে হয় অনেকাংশে সমাধান হয়ে গেছে। কারণ এখন যারা ডেলিভারি নিতে সুশৃঙ্খলভাবে লাইনে দাঁড়াচ্ছে তাদের বেশি সময় লাগছে না। সবাই সবার কাজ ভালোভাবেই করছে।’
লম্বা লাইনে হাঁসফাঁস
পাসপোর্ট অফিসের সরেজমিন চিত্র বলছে—এখানকার খুঁটি গেঁড়ে বসা দালালরা পালিয়েছে। তবে, এখনো রয়ে গেছে কিছু পুরোনো চিত্র। অনেক সেবাগ্রহীতা দূর-দূরান্ত থেকে এসে অপেক্ষা করেও ফিরে যাচ্ছেন। আবার অনেকে তিক্ত-বিরক্ত হয়েই সেবা নিচ্ছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে।
পাসপোর্ট আবেদন জমা দিতে বায়েজিদ বোস্তামি এলাকার আতুরার ডিপো থেকে আসা জাহাঙ্গীর আলম নামে এক সেবাগ্রহীতার সাথে কথা হয় প্রতিবেদকের। তিনি সকাল সাড়ে আটটায় আসলেও লাইনে দাঁড়িয়েছেন দ্বিতীয়বারের মতো।
সকাল ৮টার দিকে সীতাকুণ্ড উপজেলার ছোট কুমিরা এলাকা থেকে পাসপোর্ট আবেদন জমা দিতে আসা যুবক যিশু বলেন, ‘আমি এসেছি অনেক সকালে। এই যে এখানে একটা মাত্র কাউন্টার। তবে মানুষ অনেক বেশি। বাইরে এখনো প্রায় তিনশ মানুষ আছে লাইনে। কর্তৃপক্ষ বলছে জনবল সংকটের কারণে এই সমস্যা হচ্ছে। আমি ফাইল জমা দিয়েছি অনেক লম্বা সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে। এখন টোকেন পেয়েছি। ফাইলটি আবার রিটার্ন আসলে ছবি তুলতে যাব।’
পরামর্শ রেখে তিনি বলেন, ‘উন্নত দেশে আবেদন ফর্মে সিরিয়াল নম্বর দেওয়া হয়। আমি মালয়েশিয়াতে থাকি। আমার সেই অভিজ্ঞতা রয়েছে। সেখানে সিস্টেমটা অনেক বেটার। বাংলাদেশ ওই জায়গা থেকে পিছিয়ে আছে। এর ওপর জনবল সংকট। আন্তরিকতার ব্যাপারটাও এখানে কম। ধরুন আজ অনলাইনে আবেদন করার পরে কয়েকদিন পিছিয়ে একটা এপয়ন্টমেন্ট ডেট সেট করা যেতো। শুধু আজ যারা আবেদন করছে তারা এপয়ন্টমেন্ট ডেটে আবেদন জমা দিতো। প্রতি দুই-তিন ঘণ্টায় ১০০ জন করে ডেট ওয়াইজ এপয়ন্টমেন্ট দিলে বিষয়টা সুন্দর হতো।’
ছোট-বড় ভুলেও ফিরতে হচ্ছে
পাসপোর্টের আবেদনপত্র কিংবা কাগজপত্রে ছোট-বড় কোনো ভুল হলেই শুধরে আনার পরামর্শ দিয়ে ফিরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ করেছেন সেবাগ্রহীতাদের কেউ কেউ। দীর্ঘ লাইন পেরিয়ে আবার ফিরে আসাকে ‘হয়রানি’ মনে করছেন তারা। তাঁদের দাবি, ছোটখাটো ভুল মার্জনা করে সেখানেই ঠিক করে কাজ এগিয়ে নেওয়ার।
বদলে যাওয়া পাসপোর্ট অফিসের চিত্র নিয়ে কথা উঠতেই মারুফ নামে এক তরুণ ক্ষোভ নিয়ে বলেন, ‘আগের চেয়ে চেঞ্জ বলতে শুধু ঘুষ দিতে হচ্ছে না কোথাও। এটা ঠিক। কিন্তু হয়রানি হচ্ছি অনেক। কোনোকিছু ভুল হলে বলে আর হবে না। পরে সেটি ঠিক করে আবার লাইনে দাঁড়িয়ে আসতে হয়। এটা এক ধরনের হয়রানি। আর একটা মাত্র কাউন্টার। মানুষ বাইরে দাঁড়ানো পাঁচ শতাধিক। এসবের কোন নেওয়ার মানে হয় না।’
লাইন ভেঙে ঢুকতে দালালের খোঁজ
বেলা সাড়ে ১২টায় মূল ফটকের প্রবেশমুখে লাইনে দাঁড়ানো বাকলিয়া এলাকার বাসিন্দা শিপলুর সাথে কথা হয় প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, ‘পাসপোর্ট আবেদন জমা দিতে তিন বন্ধুসহ লাইনে দাঁড়িয়েছি দুপুর ১২টার পর। এসেই লাইনে না দাঁড়াতে জনপ্রতি ১ হাজার টাকা করে দিয়ে কন্ট্রাক্ট করার লোক খুঁজেও পিইনি। তাই বাধ্য হয়ে লাইনে দাঁড়াতে হয়েছে আমাকে।’
আগেও পাসপোর্ট করেছেন কিনা—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এক বড় ভাই পরামর্শ দিয়েছিলো টাকা দেওয়ার। তাহলে নাকি লাইন ছাড়াই আবেদন জমা দেওয়া যায়। কিন্তু এখানে তো পরিস্থিতি পুরোই চেঞ্জ।’
যা বলছেন কর্মকর্তারা
চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের উপ-সহকারী পরিচালক প্রবীর বড়ুয়া বৃহস্পতিবার বলেন, ‘সাধারণ মানুষ যেভাবে চাচ্ছে সেভাবে সেবা দেওয়ার জন্য আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। তবে আমাদের এখানে জনবল সংকটের কারণে ঠিকঠাক কাজ করতে পারছি না। আমাদের সেবা প্রদানের ক্ষমতা রয়েছে দৈনিক ৫শ জনের। সেখানে আজ ৯ শতাধিক মানুষকে সেবা দিয়েছি। এই সংকটের মধ্যেই আমরা সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি।’
ঘুষ-দুর্নীতির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘পরিবর্তিত এই বাংলাদেশে আমরা এই কার্যালয়কে ঘুষ এবং দুর্নীতিমুক্ত রাখতে বদ্ধ পরিকর। কেউ কোনো কারণে লাইন ভঙ্গ করলে সেটা কোনোভাবে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। দেশের ছাত্র-জনতা যেভাবে চেয়েছে সেভাবেই আমরা করার চেষ্টা করছি, আর তাতে সবার সহযোগিতাও দরকার।’
এক প্রশ্নের জবাবে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আনসার সদস্যরা সাদাপোশাকে দায়িত্ব পালন করছেন। আমরা তাদের নিরাপত্তা এই মুহূর্তে দিতে পারছি না। সামগ্রিক পরিস্থিতি এবং লোকবল সংকটের কারণে আবার তাদেরকে আমাদের দরকারও হচ্ছে। জনগণের স্বার্থে এবং সুষ্ঠু সেবা দিতে তাদেরকে অবশ্যই দরকার। আর এখানে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদেরও আগের সেই মনোবল নেই।’