বঙ্গবন্ধু সুড়ঙ্গের কাজ কখন শুরু কখন শেষ, জানুন খুঁটিনাটি তথ্য
অনেকটা অসম্ভব, অনেক স্বপ্নের মত সত্যি ব্যপার ঘটল কর্ণফুলী নদীর তলদেশে তৈরি হওয়া বঙ্গবন্ধু টানেল।এ নিয়ে মানুষের জানার আগ্রহ অনেক।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল বা বঙ্গবন্ধু টানেল বা বঙ্গবন্ধু সুড়ঙ্গ বা কর্ণফুলী টানেল হল কর্ণফুলী নদীর নিচে তৈরি হওয়া একটি সড়ক সুড়ঙ্গ।এ সুড়ঙ্গ শুরু নগরীর পতেঙ্গায় শেষ দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলায়।কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের জন্য ২০১৪ সালের ১০ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে বেইজিংয়ে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছিল। সেই শুরু, তারপর প্রায় নয় বছরের পরিক্রমায় সম্পূর্ণ হয়েছে টানেলের নির্মাণকাজ। শনিবার টানেলটি উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
২০১৩ সালে চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কম্পানি (সিসিসিসি) এবং হংকংভিত্তিক প্রতিষ্ঠান অভি অরূপ অ্যান্ড পার্টনারস হংকং লিমিটেড যৌথভাবে ফিজিবিলিটি স্টাডি পরিচালনা করে। ২০১৫ সালের ১২ নভেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্প অনুমোদন।
২০১৫ সালের ২৪ নভেম্বর চীনা কোম্পানি ‘চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানির’ (ফোরসি) সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষ সেতু বিভাগ। প্রথম অনুমোদনের সময় ব্যয় ৮ হাজার ৪৪৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। চীনা এক্সিম ব্যাংক দেওয়া কথা ছিল ৪ হাজার ৭৯৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে যোগান দেওয়া কথা ছিল ৩ হাজার ৬৪৭ কোটি ১৯ লাখ টাকা।
চীনা কর্তৃপক্ষের ঋণ অনুমোদন দেরি হওয়ায় প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে। ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বরের একনেক সভায় প্রায় ১ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। প্রথম সংশোধনীতে মেয়াদ দেড় বছর বাড়িয়ে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে শেষ করার টার্গেট নেওয়া হয়।
কিন্তু ওই মেয়াদেও কাজ শেষ করতে না পারায় গত জানুয়ারি মাসে ৩১৫ কোটি টাকা ব্যয় বাড়িয়ে দ্বিতীয়বার সংশোধন করা হয়। এর ফলে প্রকল্পের ব্যয় গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ১০ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা।
২০১৭ সালে প্রকল্পের কাজ শুরু হলেও ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় টানেল প্রকল্প এলাকার কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে সুইচ টিপে আনুষ্ঠানিকভাবে খনন কাজের উদ্বোধন করেন। প্রথম টিউব খননে ১৭ মাস সময় লাগলেও দ্বিতীয় টিউবটি খননে মাত্র ১০ মাসে তা শেষ করা হয়।৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই টানেলে প্রতিটি সুড়ঙ্গের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। টানেলের পূর্ব ও পশ্চিম ও প্রান্তে থাকছে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক। এ ছাড়া ৭২৭ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি ওভারব্রিজ রয়েছে আনোয়ারা প্রান্তে।
পতেঙ্গা নেভাল অ্যাকাডেমির পাশ দিয়ে নদীর তলদেশে ১৮ থেকে ৩১ মিটার গভীরতায় নেমে যাওয়া এই পাতাল পথ কর্ণফুলীর ওপারে আনোয়ারায় সিইউএফএল ও কাফকোর মাঝামাঝি এলাকা দিয়ে আবার ভূপৃষ্ঠে উঠেছে। ৩৫ ফুট প্রশস্ত ও ১৬ ফুট উচ্চতার টানেলে টিউব দুটির একটির সঙ্গে অপরটির দূরত্ব ১২ মিটারের মত। প্রতিটি টিউবে দুটি করে মোট চারটি লেইন আছে।
টানেলের উত্তরে নগরীর দিক থেকে আউটার রিং রোড, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কাঠগড় সড়ক, বিমানবন্দর সড়ক এবং পতেঙ্গা বিচ সড়ক দিয়ে টানেলে প্রবেশ করা যাবে।
নদীর দক্ষিণে আনোয়ারায় রয়েছে কোরিয়ান ইপিজেড, চায়না ইপিজেড, সিইউএফএল ও পারকি সমুদ্র সৈকত। কর্ণফুলী পেরিয়ে আনোয়ারা দিয়েই বাঁশখালী, কক্সবাজার, মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র ও মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরের সঙ্গে যুক্ত হওয়া যাবে।
শুরুতে টানেলের ভিতর গাড়ির গতিসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬০ কিলোমিটার। টানেলে কোনো থ্রি হুইলার বা মোটর সাইকেল চলাচল করতে পারবে না। টানেলের ভেতর হাঁটাও যাবে না।
টোল: টানেল ব্যবহারে বিভিন্ন যানবাহনের জন্য টোল নির্ধারণ করা হয়েছে। এই হার হল- কার, জিপ ও পিকআপ ২০০, মাইক্রোবাস ২৫০, বাস (৩১ সিটের কম) ৩০০, বাস (৩২ সিট অথবা বেশি) ৪০০, বাস (থ্রি এক্সেল) ৫০০, ট্রাক (৫ টন পর্যন্ত) ৪০০, ট্রাক (পাঁচ থেকে আট টন) ৫০০, ট্রাক (৮ থেকে ১১ টন) ৬০০, ট্রাক (থ্রি এক্সেল পর্যন্ত) ৮০০, ট্রেইলার (ফোর এক্সেল পর্যন্ত) ১০০০ টাকা এবং ট্রেইলার (ফোর এক্সেলের বেশি) এর ক্ষেত্রে ১০০০ টাকার সাথে প্রতি এক্সেলের জন্য ২০০ টাকা করে বাড়বে।
‘ওয়ান সিটি টু টাউন’: ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সঙ্গে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ককে যুক্ত করবে এই সুড়ঙ্গপথ। দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের সঙ্গে দক্ষিণ চট্টগ্রামের যোগাযোগ আরও সহজ হবে। কর্ণফুলী নদীর দুই পাড়ে চীনের সাংহাইয়ের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ গড়ে তুলতেই এই প্রকল্প। এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের মধ্যে একটি নতুন সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্য। চট্টগ্রাম বন্দরের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে এবং প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের কাজ ত্বরান্বিত করতেও এই টানেল ভূমিকা রাখবে।