বয়স ১৯, ‘স্পাইডারম্যানের’ মতো দেয়াল বেয়ে করেন চুরি
বয়স মাত্র ১৯। এই বয়সেই দুটি ‘দক্ষতা’ অর্জন করেছেন তিনি। একটি হচ্ছে দুই পা দিয়ে ছোঁয়া যায় পাশাপাশি থাকা এমন দুটি ভবনের দেয়াল বেয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ওপরে ওঠা। এভাবে মাকড়সার (স্পাইডারম্যান) মতো দেয়াল বেয়ে সাততলায় উঠতে সময় নেন কয়েক মিনিট। তাঁর আরেকটি ‘দক্ষতা’ হলো রান্নাঘরের এগজস্ট ফ্যান খুলে ফেলে সামান্য সেই ফাঁকা জায়গা দিয়ে ঘরে ঢোকা এবং নগদ অর্থ ও স্বর্ণালংকার নিয়ে একই পথে দিয়ে বের হয়ে আসা।
যাঁর কথা বলা হচ্ছে, তাঁর নাম রোমান আহম্মেদ। তিনি একজন পেশাদার চোর। বিশেষ ওই কৌশল ব্যবহার করে তিনি বাসাবাড়িতে চুরি করেন। থাকেন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের চনপাড়ায়। তাঁকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় চনপাড়ার একটি পেশাদার অপরাধীচক্র।
ঢাকার ডেমরার মাতুয়াইলের একটি বহুতল ভবনের সপ্তম তলার একটি ফাঁকা বাসায় চুরির ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে গত ২৫ এপ্রিল রোমান আহম্মেদকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপরই তাঁর অভিনব ‘কৌশল’ ও ‘দক্ষতার’ বিষয়টি সম্পর্কে জানতে পারে পুলিশ।
মাতুয়াইলের ওই বাসার বাসিন্দারা ২১ থেকে ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত চার দিন ঢাকার বাইরে বেড়াতে গিয়েছিলেন। ২৪ এপ্রিল বাসার তালা খুলে ঘরে ঢুকে তাঁরা দেখেন, আলমারির তালা ভাঙা, ঘরের জিনিসপত্র এলোমেলো। বাসা থেকে ২৫ লাখ টাকাসহ ৩৫ লাখ টাকার মালামাল নেই। অথচ বাসার তালা অক্ষত আছে। কোথাও গ্রিল কাটা নেই। এমনকি ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরায়ও কাউকে বাসায় ঢুকতে বা বের হতে দেখা যায়নি।
পুলিশের ডেমরা অঞ্চলের সহকারী কমিশনার (এসি) মধুসূদন দাস বলেন, রোমান কিশোর বয়স থেকেই চুরি করেন। চার-পাঁচ বছর ধরে চুরি করতে করতে ‘মাকড়সা’র মতো দেয়াল বেয়ে ওপরে ওঠার দক্ষতা অর্জন করেন। সর্বশেষ যে বাসায় তিনি চুরি করেছেন, ওই বাসার রান্নাঘরের এগজস্ট ফ্যানের জায়গাটি ছিল ১১ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য ও ৬ ইঞ্চি প্রস্থের (৬৬ বর্গইঞ্চি)।
চুরি করে জামিনের অর্থ পরিশোধ
পুলিশ জানায়, এর আগে একটি মুঠোফোন চুরির মামলায় গত ৩ এপ্রিল রোমান আহম্মেদকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৬ দিন কারাগারে থাকার পর ১৯ এপ্রিল তিনি জামিনে মুক্তি পান। মুক্ত হওয়ার চার দিন পরেই তিনি মাতুয়াইলের ওই বাসায় চুরি করেন।
পুলিশ কর্মকর্তা মধুসূদন দাস বলেন, এপ্রিলের শুরুর দিকে মুঠোফোন চুরির মামলায় রোমানসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তাঁর সঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া অন্যজন হলেন ২৮ বছর বয়সী ফয়সাল। ফয়সাল একজন পেশাদার চোর। ফয়সালের কাছ থেকেই চুরির কৌশল শেখেন রোমান।
মধুসূদন দাসের ভাষ্য, এই চোরচক্রের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেন চনপাড়ার শাহ আলম নামে ৩৫ বছর বয়সী এক ব্যক্তি। রোমান গ্রেপ্তার হওয়ার পর শাহ আলম তাঁকে জামিনে মুক্ত করেন। এই জামিনের জন্য যে অর্থ খরচ হয়, তা মাতুয়াইলের বাসায় চুরির পর শাহ আলমকে পরিশোধ করেন রোমান। মাতুয়াইলের বাসায় চুরির মামলায় ১ মে শাহ আলম ও তাঁর ভায়রা জাকিরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের আশ্রয়ে চনপাড়াকেন্দ্রিক আরও অন্তত তিনটি চোরচক্র বিভিন্ন এলাকায় চুরি করে।
শাহ আলম একজন পেশাদার অপরাধী জানিয়ে সহকারী পুলিশ কমিশনার মধুসূদন বলেন, শাহ আলম মাদক কারবারে জড়িত। তাঁকে গ্রেপ্তারের সময় ১০০ গ্রাম হেরোইন উদ্ধার করা হয়েছে। চনপাড়ায় শাহ আলমের দুটি বাড়ি রয়েছে। সেখানে তিনি বিলাসবহুল জীবনযাপন করেন। এ ছাড়া ডেমরায় তিনি একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকেন। চোরচক্রের কোনো সদস্য গ্রেপ্তার হলে তিনি জামিনের ব্যবস্থা করেন। মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধে যুক্ত হয়ে তিনি এখন কোটি টাকার সম্পদের মালিক।
চুরির টাকায় গ্যারেজ করার পরিকল্পনা
মাতুয়াইলের বাসায় ৩৫ লাখ টাকার মালামাল চুরির পর রোমান আহম্মেদ ঘনিষ্ঠদের বলছিলেন, তাঁর কপাল খুলে গেছে। রোমানের বাবা গাজীপুরে রিকশা চালান। তাঁর ভাই দিনমজুরের কাজ করেন। তিনি বাবার জন্য একটি গ্যারেজ করার পরিকল্পনা করেন।
পুলিশের ডেমরা অঞ্চলের সহকারী কমিশনার মধুসূদন দাস বলেন, চুরির পর রোমান কিছু টাকা ধার পরিশোধ করেন। জামিনে বের করার জন্য শাহ আলম যে টাকা খরচ করেছিলেন, সেটি পরিশোধ করেন। আবার কখনো গ্রেপ্তার হলে জামিনে মুক্ত করার জন্য অগ্রিম টাকাও দিয়েছিলেন শাহ আলমকে। নিজের জন্য একটি মোটরসাইকেল কেনার পরিকল্পনা ছিল তাঁর। বাবা ও ভাইয়ের জন্য একটি গ্যারেজ করার পরিকল্পনাও করেন তিনি। নিজে এবং বন্ধুদের নিয়ে মাদকের পার্টিও দিয়েছিলেন।
রোমানের কাছ থেকে ছয় লাখ টাকা এবং বেশ কিছু বিদেশি মুদ্রা উদ্ধার করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
চুরির জন্য বাসাবাড়ির খোঁজ
মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এই চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে খোঁজ করেন, কোন বাসার লোকজন ফ্ল্যাট তালাবদ্ধ করে ঢাকার বাইরে গেছেন। তাঁরা মূলত দেখেন, কোন বাসায় রাতে টানা তিন দিন আলো জ্বলছে না। সেটি দেখেই নিশ্চিত হন, বাসাটি ফাঁকা। তারপর ওই বাসার সিসি ক্যামেরার অবস্থান খুঁজে বের করেন। সাধারণত বাসাবাড়ির পেছনের দিকে সিসি ক্যামেরা থাকে না। এ সুযোগে পেছনের দেয়াল বেয়ে ওপরে উঠে ফাঁকা বাসায় চুরি করেন রোমান।
পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন বলেন, মাতুয়াইলের যে বাড়িতে চুরি হয়েছে, ওই বাড়ির প্রবেশমুখ, সিঁড়িসহ বিভিন্ন জায়গায় সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল। তবে চোর বাসায় প্রবেশ করেছে বাড়ির পেছন দিয়ে। এ কারণে সেটি ধরা পড়েনি। আবার ভেন্টিলেটর দিয়ে বাসায় প্রবেশ করেছে, মালামাল নিয়ে বের হয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তা ইকবাল হোসাইন বলেন, শুধু সামনের অংশ নয়, পুরো বাসাবাড়িকেই সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনা উচিত। পাশাপাশি ভেন্টিলেটর ও গ্রিল বসানোর সময় বাড়িওয়ালাদের সতর্ক থাকতে হবে। ভেন্টিলেটর এমনভাবে স্থাপন করতে হবে যেন সেখান দিয়ে কেউ প্রবেশ করতে না পারে। কেউ যদি দীর্ঘ সময় বাসা ফাঁকা রেখে যান, বাসার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট এলাকার দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্মকর্তাকে জানিয়ে যেতে পারেন।