রাজনীতি

ভোটে-জোটে না থাকলেও সমীকরণে থাকতে চায় যারা

ভোটে পিছিয়ে থাকলেও জোটের রাজনীতিতে এগিয়েছে অনেক রাজনৈতিক দল। বড় দুই রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জোট করে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছে কোনো কোনো দল। আবার কোনো দল থেকে সরকার পরিচালনায় মন্ত্রীও হয়েছে। আবার অনেক দল ভোটে নেই। নেই কোনো জোটে। তবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সমীকরণে শক্ত অবস্থানে আসতে চায় অনেক দলই।

সংবিধান অনুযায়ী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনড় অবস্থানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ‌‌‌। এ অবস্থানে সমর্থন রয়েছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় ১৪ দলের শরিক দলগুলোর।

তবে বর্তমান সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি (জাপা-এরশাদ) কোন অবস্থানে আছে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। দলটির চেয়ারম্যান পদ নিয়ে এরশাদের ভাই জি এম কাদের ও স্ত্রী রওশন এরশাদের মধ্যে বরাবরই দ্বন্দ্ব চলে আসছে। জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর দলের চেয়ারম্যান পদে জি এম কাদের দায়িত্ব নিয়ে রওশন এরশাদকে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা ও দলটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ঘোষণা দেন। তবে অন্তর্দ্বন্দ্বে জেরবার জাতীয় পার্টিতে গেল আগস্টেও দলের একাংশের সমর্থন নিয়ে নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন রওশন এরশাদ। আর জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু এ ঘোষণাকে উড়িয়ে দিয়ে বলেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এ ঘোষণার ভিত্তি নেই। দলের শীর্ষ নেতাদের অনেকে নাম প্রকাশ না করে জানান, রওশন এরশাদ বরাবরের মতো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৃপাধন্য হয়ে সরকারের সঙ্গে থাকতে চান, তবে সরকারবিরোধী অংশের দিকে চোখ রেখেছে জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন দলের মূল অংশ। তার সাম্প্রতিক বক্তব্যগুলোতে এর ইঙ্গিত মেলে। যদিও নির্বাচনী রাজনীতিতে বিএনপির বিরোধিতার সুফল হিসেবে এতদিন কখনো জোটে, কখনো শাসক দল আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় থেকে মাঠের চেয়ে সংসদে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে জাপা। ফলে ভোটের রাজনীতিতে দলটি কোনো পক্ষে যাবে, নাকি একক অবস্থানে থাকবে, তা হয়তো নির্ভর করবে তারা কোনো প্রস্তাব পাচ্ছে কি না তার ওপর।

অন্যদিকে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি বিএনপির। এই দাবিতে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে যোগ দিয়েছে তার পুরোনো জোট শরিক ও নতুন কিছু দল। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনরত দলের সংখ্যা প্রায় ৪৩টি।

এদিকে, বৃহৎ দুই রাজনৈতিক বলয়ের বাইরে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত অনেক রাজনৈতিক দল রয়েছে। যারা ক্ষমতাসীন পক্ষ বা আন্দোলনরত বিরোধীদের কোনো পক্ষেই অবস্থান স্পষ্ট করেনি। ভোটের মাঠে এদের শক্ত অবস্থান তেমন একটা না থাকলেও রাজনীতির মাঠে মধ্যপন্থা অবলম্বন করে বৃহৎ বলয়ের সঙ্গে দরকষাকষির কৌশলে রয়েছে দলগুলো। এ দলগুলোর অনেক নেতাই বলছেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চান তারা। তবে তারা কোনো জোটে নেই।

২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। ওই ফ্রন্টের প্রধান শরিক দল ছিল বিএনপি। নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে গণফোরাম ভেঙে যায়। দলটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসীন মন্টু ও সুব্রত চৌধুরী পাল্টা গণফোরাম তৈরি করেন। অন্যদিকে ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে গণফোরামের মূল অংশের সাধারণ সম্পাদক হন মিজানুর রহমান।

গত ২৯ আগস্ট জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে জাতির জন্য গণতন্ত্রহীনতা বড় সংকট আখ্যা দিয়ে এই সংকট থেকে উত্তরণে ৬ দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেন ড. কামাল হোসেন। সেই সঙ্গে দ্বাদশ নির্বাচনের আগে সংলাপের আয়োজন করতে সরকারকে আহ্বান জানান তিনি।

গণফোরাম সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বলেন, আমরা কর্মসূচির মধ্যে আছি। এর আগে মানববন্ধন করেছি। বিক্ষোভ মিছিল করেছি। আমাদের দলের সংসদ সদস্য সংসদে কথা বলেছেন দলের পক্ষে। ভবিষ্যতে আরও নতুন নতুন কর্মসূচি আসবে।

২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক দল ছিল বাংলাদেশ ন্যাপ। জোটের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে দলটির চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানী ওই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। নির্বাচনের পর জোট ভেঙে বেরিয়ে গেলেও নতুন করে কোনো জোটে অংশ নেয়নি তার দল। দলটির মহাসচিব এম গোলাম মোস্তফা ভুইয়া দৈনিক বাংলাকে বলেন, আমরা সবার অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাই। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে উভয় দলের মধ্যে সংলাপ হওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। যদি সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি হয় এবং অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ওই নির্বাচনে অংশ নেয়, তাহলে আমরাও সেই নির্বাচনে অংশ নেব।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে থাকলেও দীর্ঘদিন থেকেই জোটের সঙ্গে নেই বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও বাসদ। বিএনপির নেতৃত্বে চলমান যুগপৎ ধারার আন্দোলনের দাবির মতো দাবি থাকলেও যুগপৎ আন্দোলনে নেই দল দুটি। নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তদারকি সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে নানা কর্মসূচি পালন করছে সিপিবি-বাসদ। এসব কর্মসূচিতে যুক্ত হয়েছে সিপিবি-বাসদের নেতৃত্বাধীন বাম গণতান্ত্রিক জোট।

জোটটির অন্যতম নেতা ও সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘আমাদের আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ব্যবস্থার পরিবর্তন। বর্তমান সরকারের দুঃশাসনের বদলে বিএনপি বা অন্যদের বসানো লক্ষ্য নয়। ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম মোর্চা, ঐক্য ন্যাপ ও বাংলাদেশ জাসদের সঙ্গে যুগপৎ কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। ফলে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই।

আদর্শগত মিল না থাকায় বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গে বাম জোট নেই বলে জানান সিপিবির সাধারণ সম্পাদক। তিনি বলেন, আদর্শিক অবস্থান থেকে বাম জোট আওয়ামী লীগ-বিএনপির দ্বিদলীয় ধারার বাইরে একটি স্বতন্ত্র ধারা সৃষ্টি করতে চাইছে।

২০১৮ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট ছাড়ার ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ জাসদ। চলতি বছরেই নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পায় দলটি। ফেডারেল পদ্ধতির শাসন চালু করে বাংলাদেশের বিভাগগুলোকে প্রদেশে পরিণত করা, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট জাতীয় সংসদ ও সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা চালু, জাতীয় সংসদ সদস্যদের স্বাধীন মত প্রকাশের সুযোগ সৃষ্টির জন্য ৭০ ধারার সংশোধন, স্বশাসিত, শক্তিশালী ও সংসদীয় পদ্ধতির স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় মার্কা বাতিল, স্থানীয় সরকার কমিশন গঠনসহ ৮ দফা দাবি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ জাসদ।

বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তনশীল বলে মনে করছেন বাংলাদেশ জাসদ সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া। দৈনিক বাংলাকে তিনি বলেন, আমরা সবার অংশগ্রহণে আগামী সংসদ নির্বাচন চাই। বর্তমান সরকার যেভাবে নির্বাচন করতে চাচ্ছে, সেই নির্বাচনে অংশ নেয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এখন আমরা কোনো জোটে নেই। ভবিষ্যতের রাজনীতি ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d