ধর্ম

মারিয়াম (আ.) জান্নাতের শ্রেষ্ঠ ৪ নারীর অন্যতম: আল্লাহ নিজেই রেখেছিলেন তাঁর নাম

মারিয়াম (আ.) ছিলেন তার মায়ের মানতের সন্তান। আল্লাহ পাক নিজেই রেখেছিলেন তাঁর নাম । মারিয়ামের গর্ভধারণ ও ঈসা (আ.) এর জন্মগ্রহণ ছিল সম্পূর্ণরূপে অলৌকিক ঘটনা। আল্লাহ পাক নিয়মের স্রষ্টা এবং তিনিই নিয়মের ভিন্ন ব্যবহারকারী। তাকে কোনো বিষয়ে বাধ্য করার মত কেউ নেই। তিনি পিতা-মাতা ছাড়াই আদম (আ.)কে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর পিতা ছাড়াই শুধু মাতার মাধ্যমে ঈসা (আ.) কে সৃষ্টি করেছেন। তিনি যা খুশি তাই করতে পারেন। সবকিছুর উপর একক আধিপত্য একমাত্র আল্লাহর।

ইমরান (আ.)এর স্ত্রী “হান্না” দীর্ঘদিন সন্তান কামনা করেছিলেন।কিন্তু তাতে সফলতা আসেনি। ফলে নিজেকে সন্তান জন্ম দানে অক্ষম ভাবতেন। একদিন তিনি একটি গাছের ছায়ায় থেকে দেখতে পেলেন, একটি পাখি তার ছানাকে খাওয়াচ্ছে। এটা দেখে সন্তানের প্রতি তার হৃদয়ে অধিক স্নেহ জেগে উঠল। তিনি সন্তান কামনা করে বললেন,“হে প্রভু, আপনার কাছে আমার একটি মানত রয়েছে, যদি আপনি আমাকে একটি পুত্র সন্তান দান করেন, আমি শুকরিয়া স্বরূপ তাকে বাইতুল মুকাদ্দাসে দান করে দিব, যাতে সে তার খাদেমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়”। আল্লাহ তাঁর দোয়া কবুল করলেন। আল্লাহর ইচ্ছায় তিনি গর্ভধারণ করলেন।গর্ভাবস্থায় তার স্বামী ইমরান (আ.)মারা গেলেন।

তিনি ভেবেছিলেন যে,নিজের গর্ভস্থ সন্তান পুত্র সন্তান হবে। তাকে আল্লাহর ঘর বায়তুল মুক্বাদ্দাসের খিদমতে নিয়োজিত করবেন। কিন্তু যখন তিনি কন্যা সন্তান প্রসব করলেন, তখন আক্ষেপ করে বললেন, ‘হে আল্লাহ! আমি কন্যা প্রসব করেছি’?। অর্থাৎ একে দিয়ে তো আমার মানত পূর্ণ হবে না। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা ছিল অন্যরূপ। তিনি সেই কন্যাকেই কবুল করে নেন। বস্তুত ইনিই ছিলেন মারিয়াম বিনতে ইমরান, যিনি ঈসা (আ.)-এর কুমারী মাতা। রাসূলুল্লাহ (সা.) যাকে জান্নাতের শ্রেষ্ঠ চারজন নারীর অন্যতম হিসাবে বর্ণনা করেছেন। হাদীসে আছে-‘জান্নাতবাসী মহিলাগণের মধ্যে সেরা হলেন চারজন: খাদীজা বিনতে খুওয়ালিদ, ফাতেমা বিনতে মুহাম্মাদ, মারিয়াম বিনতে ইমরান এবং আসিয়া বিনতে মুযাহিম, যিনি ফেরাঊনের স্ত্রী’।
অতঃপর সে যখন তাকে প্রসব করল, তখন বলল, হে প্রভু! আমি তো কন্যা সন্তান প্রসব করেছি! অথচ আল্লাহ ভালো করেই জানেন, সে কি প্রসব করেছে। (আল্লাহ সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,) এই কন্যার মত কোনো পুত্রই যে নেই। আর আমি তার নাম রাখলাম ‘মারিয়াম’।মারিয়ামের মা দোয়া করে বলল, হে আল্লাহ! আমি তাকে ও তার সন্তানদেরকে তোমার আশ্রয়ে সমর্পণ করছি, অভিশপ্ত শয়তানের কবল হতে । আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর তার প্রভু তাকে উত্তমভাবে গ্রহণ করে নিলেন এবং তাকে প্রবৃদ্ধি দান করলেন সুন্দর প্রবৃদ্ধি। আর তিনি তাকে যাকারিয়ার তত্ত্বাবধানে সমর্পণ করলেন। যখনই যাকারিয়া মেহরাবের মধ্যে তার কাছে আসতেন, তখনই কিছু খাদ্য দেখতে পেতেন। তিনি জিজ্ঞেস করতেন, মারিয়াম! এসব কোথা থেকে তোমার কাছে এল? মারিয়াম বলত, ‘এসব আল্লাহর নিকট থেকে আসে। নিশ্চয়ই আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বেহিসাব রিযিক দান করে থাকেন’।
আল্লাহর নামে উৎসর্গীত সন্তান পালন করাকে তখনকার সময়ে খুবই পুণ্যের কাজ মনে করা হত। আর সেকারণে মারিয়ামকে প্রতিপালনের দায়িত্ব নেয়ার জন্য রীতিমত প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। ফলে লটারীর ব্যবস্থা করা হয় এবং আল্লাহর ইচ্ছায় বয়োবৃদ্ধ নবী হযরত যাকারিয়া (আ.) মারিয়ামের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন।

এভাবে মেহরাবে অবস্থান করে মারিয়াম বায়তুল মুক্বাদ্দাসের খিদমত করতে থাকেন। সম্মানিত নবী ও মারিয়ামের বয়োবৃদ্ধ খালু যাকারিয়া (আ.) সর্বদা তাকে দেখাশুনা করতেন। মেহরাবের উত্তর-পূর্বদিকে খেজুর বাগান ও ঝর্ণাধারা ছিল। যেখানে মারিয়াম পর্দা টাঙিয়ে মাঝে-মধ্যে পায়চারি করতেন। অভ্যাসমত তিনি সেই নির্জন স্থানে একদিন পায়চারি করছিলেন। এমন সময় হঠাৎ মানুষের বেশে সেখানে জিবরাঈল উপস্থিত হন। স্বাভাবিকভাবেই তাতে মারিয়াম ভীত হয়ে পড়েন।
এ বিষয়ে কুরআনী বর্ণিত আছে-(হে মুহাম্মাদ!)‘আপনি এই কিতাবে মারিয়ামের কথা বর্ণনা করুন। যখন সে তার পরিবারের লোকজন হতে পৃথক হয়ে পূর্বদিকে একস্থানে আশ্রয় নিল’।‘অতঃপর সে তাদের থেকে আড়াল করার জন্য পর্দা টাঙিয়ে নিল।অতঃপর আমরা তার নিকটে আমাদের ‘রূহ’ (অর্থাৎ জিব্রাইলকে) প্রেরণ করলাম। সে তার কাছে গিয়ে পূর্ণাঙ্গ মানবাকৃতিতে আত্মপ্রকাশ করল’।‘মারিয়াম বলল, আমি তোমার থেকে করুণাময় আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করছি, যদি তুমি আল্লাহভীরু হও’।‘সে বলল, আমি তো কেবল তোমার প্রভুর প্রেরিত। এজন্য যে, আমি তোমাকে একটি পবিত্র পুত্র সন্তান দান করে যাব’।‘মারিয়াম বলল, কিভাবে আমার পুত্র সন্তান হবে? অথচ কোনো মানুষ আমাকে স্পর্শ করেনি এবং আমি ব্যভিচারিণী নই’।‘সে বলল, এভাবেই হবে। তোমার পালনকর্তা বলেছেন, এটা আমার জন্য সহজ ব্যাপার এবং আমরা তাকে (ঈসাকে) মানবজাতির জন্য একটা নিদর্শন ও আমাদের পক্ষ হতে বিশেষ অনুগ্রহরূপে পয়দা করতে চাই। তাছাড়া এটা (পূর্ব থেকেই) নির্ধারিত বিষয়’ (মারিয়াম:১৬-২১)। অতঃপর জিব্রাইল (আ.) মারিয়ামের মুখে অথবা তাঁর পরিহিত জামায় ফুঁক মারলেন এবং তাতেই তাঁর গর্ভ সঞ্চার হল ।

আল্লাহ বলেন,‘অতঃপর মারিয়াম গর্ভে সন্তান ধারণ করল এবং একটু দূরবর্তী স্থানে চলে গেল’।‘এমতাবস্থায় প্রসব বেদনা তাকে একটি খেজুর বৃক্ষের মূলে আশ্রয় নিতে বাধ্য করল। তখন সে বলল, হায়! আমি যদি এর আগেই মারা যেতাম এবং আমি যদি মানুষের স্মৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে যেতাম’।‘এমন সময় ফেরেশতা তাকে নিম্নদেশ থেকে (অর্থাৎ পার্শ্ববর্তী নিম্নভূমি থেকে) আওয়াজ দিয়ে বলল, তুমি দুঃখ করো না। তোমার পালনকর্তা তোমার পাদদেশে একটি ঝর্ণাধারা সৃষ্টি করেছেন’।‘আর তুমি খেজুর বৃক্ষের কান্ড ধরে নিজের দিকে নাড়া দাও, তা থেকে তোমার দিকে সুপক্ক খেজুর পতিত হবে’।‘তুমি আহার কর, পান কর এং স্বীয় চক্ষু শীতল কর।আর যদি কোনো মানুষকে তুমি দেখ, তবে তাকে বলে দিয়ো যে, আমি দয়াময় আল্লাহর জন্য ছিয়াম পালনের মানত করেছি। সুতরাং আমি আজ কারো সঙ্গে কোন মতেই কথা বলব না’ (মারিয়াম:১৯-২৬)।
তখন ছিয়াম পালনের সঙ্গে অন্যতম নিয়ম ছিল সারাদিন মৌনতা অবলম্বন করা। হযরত যাকারিয়া (আঃ)-কেও সন্তান প্রদানের নিদর্শন হিসাবে তিন দিন ছিয়ামের সঙ্গে মৌনতা অবলম্বনের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। তবে ওই অবস্থায় ইশারা-ইঙ্গিতে কথা বলার অবকাশ ছিল।একইভাবে মারিয়ামকেও নির্দেশ দেয়া হল ।

অতঃপর মরিয়ম (আ.) সন্তানকে নিয়ে তার সম্প্রদায়ের নিকট উপস্থিত হলেন। তারা বলল, হে মরিয়ম, তুমি তো এক অদ্ভুত কান্ড করে বসেছ। হে হারুনের বোন, তোমার পিতা অসৎ ব্যক্তি ছিল না এবং তোমার মাতাও ছিল না ব্যভিচারিণী। অতঃপর মরিয়ম ইঙ্গিতে সন্তানকে দেখাল। তারা বলল,যে দোলনার শিশুর সাথে আমরা কেমন করে কথা বলব?’
আল্লাহ পাক স্বীয় শক্তিতে তাকে বলালেন, (শিশুটি) বলল, নিশ্চয় আমি আল্লাহর বান্দা। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন এবং আমাকে নবি বানিয়েছেন। যেখানেই আমি থাকি না কেন, তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন। তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন আজীবন নামায ও যাকাত আদায় করতে। আমার মায়ের প্রতি অনুগত করেছেন। আর তিনি আমাকে করেননি উদ্ধত, হতভাগ্য।
এসব কথা শুনে গোত্রের লোকদের চেহারা বিস্মিত হয়েছিল। মরিয়ম আ.-এর নির্দোষতা প্রকাশ পেয়েছিল। তার কাছে বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে গেলে, তিনি আল্লাহর অনুগ্রহের জন্য তার কৃতজ্ঞতা স্বীকার করলেন।
তিনিই একমাত্র নারী যিনি গর্ভবতী হন এবং কুমারী থাকা অবস্থায় সন্তান প্রসব করেন।আর এটি আল্লাহর পক্ষ হতে বিশ্ববাসীর জন্য তার অলৌকিক ঘটনা। এটি একটি অনুস্মারক মানুষের জন্য প্রথম মানব আদম আ.-এর সৃষ্টি সম্পর্কে ও আল্লাহই স্রষ্টা। তিনিই একমাত্র নারী যার নামে একটি সুরার নামকরণ করা হয়েছে এবং আল্লাহ পাক কুরআনে তার নাম দিয়ে উল্লেখ করেছেন। তিনি বিশ্বের মহিলাদের সবচেয়ে মর্যাদাবান।

সন্তান জন্মদানের পর দুর্বল অবস্থায় আল্লাহপাক তাঁকে পরিষ্কার হওয়ার জন্য পাশে ঝর্ণাধারা সৃষ্টি এবং রিযিকের ব্যবস্থা করেন। তাঁকে বলেন,‘আর তুমি খেজুর বৃক্ষের কান্ড ধরে নিজের দিকে নাড়া দাও, তা থেকে তোমার দিকে সুপক্ক খেজুর পতিত হবে’।‘তুমি আহার কর,পান কর এং স্বীয় চক্ষু শীতল কর।

তাতে বুঝা যায়, বান্দাকে কেবল প্রার্থনা করলেই চলবে না, তাকে কাজে নামতে হবে। তবেই তাতে আল্লাহর সাহায্য নেমে আসবে। যেমন খেজুর বৃক্ষের কান্ড ধরে নাড়া দেওয়ার সামান্য প্রচেষ্টার মাধ্যমে আল্লাহর হুকুমে সুপক্ক খেজুর পতিত হয়।
পবিত্র কোরআনে একমাত্র মারিয়ামের নাম ধরেই আল্লাহ তাঁর সতীত্বের সাক্ষ্য ঘোষণা করেছেন । যা পৃথিবীর অন্য কোন নারী সম্পর্কে করা হয়নি। তাছাড়া আল্লাহ তাঁকে ‘ছিদ্দীক্বাহ’ অর্থাৎ কথায় ও কর্মে ‘সত্যবাদীনী’ আখ্যা দিয়েছেন । যেটা অন্য কোন নারী সম্পর্কে দেয়া হয়নি।

আরও পড়ুনঃ  উপুড় হয়ে ঘুমানোর বিষয়ে ইসলামের বিধান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d