শাসকদের ভুলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি
শাসকদের ভুলে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে বলে মনে করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, এতে মূল ভূমিকা পালন করছে রাষ্ট্রীয় সুবিধা ব্যবহার করে তৈরি হওয়া অলিগার্করা। এক আলোচনা অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনায় এমন মন্তব্য করেন এই অর্থনীতিবিদ।
শনিবার (১ জুন) ‘বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতা: সংকট ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এই আলোচনার আয়োজন করে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। অনুষ্ঠানে ‘শাসককুলের ভুল ও খামখেয়ালিপনার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি বিপদের সম্মুখীন’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনা করেন মইনুল ইসলাম। রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে এই আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতিত্ব করেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন।
বিপুল অর্থের অধিকারী এমন এক গোষ্ঠী যারা রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করে বিত্ত গড়ে তোলে, তারাই মূলত অলিগার্ক হিসেবে পরিচিত।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনায় মইনুল ইসলাম বলেন, ‘একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দেশে একরকম একনায়কতন্ত্র চলছে।’ কিছু ব্যবসায়ীর নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, এসব ব্যবসায়ীর নেতৃত্বে নানা নীতি প্রণয়ন করা হয়। একজন ব্যবসায়ীর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাঁর মতো ব্যবসায়ীর পদে থাকা দেশের জন্য অনেকটা অশোভনীয়।
মইনুল ইসলাম বলেন, পুঁজি পাচার অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সমস্যা; হুন্ডি কমাতেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ডলারের দাম তাঁদের কাছে কিছুই না। এখন অনেক ক্ষেত্রে ১৩০ টাকা দিয়ে ডলার কিনে আমদানি করতে হচ্ছে। সরকার এসবের বিরুদ্ধে (অর্থ পাচার ও হুন্ডি) ব্যবস্থা নেয়নি, বরং পাচারের টাকা ফেরাতে কর ছাড়সহ নানা সুবিধা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এক টাকাও দেশে ফেরেনি।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ব্যাংকঋণের অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে। ব্যাংক খাতে ১৮ লাখ কোটি টাকা ঋণের সাড়ে ৫ লাখ কোটি টাকাই খেলাপি। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক তা স্বীকার করে না। ব্যাংকঋণ শোধ করা হচ্ছে নতুন করে নেওয়া ঋণের টাকা দিয়ে। এক ঋণ সাত-আটবার পুনঃ তফসিল করা হচ্ছে। বাজারে গেলে মূল্যস্ফীতির শিকার হতে হয়। অন্য দেশ তা কমাতে পারলেও বাংলাদেশ পারেনি। অর্থনীতির এই দশা হয়েছে শাসকদের ভুলের কারণে।
মইনুল ইসলাম বলেন, এখন নতুন করে সাবেক পুলিশ ও সেনাবাহিনী প্রধানের নাম আলোচনায় আসছে। সরকার চাইছে বলেই তাদের ধরা হচ্ছে। তবে তিনি প্রশ্ন তোলেন, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর পদ্মা ব্যাংক করার টাকা কোথায় পেয়েছিলেন। বেসিক ব্যাংকের বাচ্চু (আব্দুল হাই) এখনো অধরা কেন। ন্যাশনাল ব্যাংককে নষ্ট করা সিকদারপুত্ররা কোথায়।
তাঁর প্রবন্ধে মইনুল ইসলাম আরও বলেন, ‘রূপপুরের মতো প্রকল্প ভারতে অর্ধেক টাকায় করে দিয়েছে রাশিয়া। তাহলে কেন আমাদের বেশি অর্থ খরচ হচ্ছে। এমন অনেক অপ্রয়োজনীয় অবকাঠামো করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে লুটপাট হচ্ছে। বড় অপ্রয়োজনীয় অবকাঠামো করে শ্রীলঙ্কা ধসে গেছে। আমরাও এমন খামখেয়ালি করে একই পথে চলছি। ২০০৮ সালের পর দেশে কোন ভালো নির্বাচন হয়নি। সব একতরফা নির্বাচন হয়েছে। গণতন্ত্র থেকে বিচ্যুত হওয়াটা দেশের জন্য অশনিসংকেত। অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়ছে।’
অনুষ্ঠানে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, গণমাধ্যমের পাশাপাশি অর্থনীতির বেহাল দশা আমরা জীবনযাত্রা দিয়ে বুঝতে পারছি। বাজারে গেলেই টের পাওয়া যাচ্ছে অর্থনীতি কেমন আছে। এ জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা আছে। এর মধ্যে আবার পানির দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, গ্যাস-বিদ্যুতের দামও বেড়েছে।
রাশেদ খান মেনন বলেন, সিন্ডিকেট বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে, সরকারি দলের নেতারাও একই কথা বলছেন। এ নিয়ে কারও কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু সিন্ডিকেটে কারা আছে, তা জানার চেষ্টা হচ্ছে না। সিন্ডিকেটের বেশির ভাগই সরকার ঘনিষ্ঠরা। সামরিক-বেসামরিক আমলা ও ধনিকগোষ্ঠীর ক্ষুদ্র অংশ এই অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের মধ্যেই সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ছে।
ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরো সদস্য সুশান্ত দাস বলেন, ‘দেশে যখন লু হাওয়া শুরু হয়, তখন দরবেশ বাবাদের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়। তারাই এখন সবকিছুর নিয়ন্ত্রক। রাষ্ট্রযন্ত্রগুলোও এখন তাদের পক্ষে।’
আলোচনায় আরও বক্তব্য দেন ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা।